ছাত্রজনতার রক্ত আর হুন্ডির টাকায় গড়ে উঠেছে ওয়ালিদের সাম্রাজ্য


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ১২:২৩ পিএম, ৪ঠা আগস্ট ২০২৫


ছাত্রজনতার রক্ত আর হুন্ডির টাকায় গড়ে উঠেছে ওয়ালিদের সাম্রাজ্য
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া।

ঢাকার গুলশান এভিনিউয়ে গ্যালাক্সি গ্রুপের আলিশান কার্যালয়ের কাচঘেরা দেয়ালে ঝুলছে একাধিক রাজনৈতিক হেভিওয়েটদের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল ছবি।  আওয়ামী লীগের তোফায়েল আহমেদ, সালমান এফ রহমান,  হাসানুল হক ইনু সবার সাথেই রয়েছেন প্রতিষ্ঠানের এমডি ইউসুফ ওয়ালিদ কিংবা তার পরিবারের অন্য সদস্যরা। ছবি শুধু নয়, এসব চিত্রই নাকি গ্যালাক্সি সাম্রাজ্যের ক্ষমতার প্রতীক, যা দেখিয়ে দেশে-বিদেশে আদায় করা হয়েছে কোটি কোটি টাকার অনৈতিক সুবিধা।


সূত্র জানিয়েছি,পাসপোর্ট নম্বর ৫০৫ ০০৯৮ (বা ১০০০০০২০০)-এর মালিক ইউসুফ ওয়ালিদ বাংলাদেশের পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাতে দ্বিতীয় বসত গড়ে তুলেছেন। দুবাইতে রয়েছে তার একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি-গাড়ি। সেখানেই বসবাস করেন পরিবারসহ, মেয়ের লেখাপড়াও চলছে সেখানে। শুধু তা-ই নয়, থাইল্যান্ডে তার মালিকানাধীন রয়েছে একটি বিলাসবহুল হোটেল, যার বিনিয়োগের উৎস নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে গ্যালাক্সি গ্রুপ ও এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান জিবিএক্স লজিস্টিকসের বিরুদ্ধে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা কর ফাঁকির অভিযোগ এনেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তদন্তে উঠে আসে, আন্তর্জাতিক শিপিং ব্যবসা থেকে বড় কমিশন আয় করলেও সেসব আয়ের যথাযথ হিসাব দাখিল করা হয়নি। এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল তদন্ত শেষে একটি দাবি সম্বলিত নোট পাঠায় উপকর কমিশনার বরাবর। কিন্তু এরপরই শুরু হয় ম্যানেজমেন্ট খেলা। কারণ, ওয়ালিদের পিছনে তখন আওয়ামী লীগের হেভিওয়েটদের ছায়া যাদের সঙ্গে প্রকাশ্যেই তার ছবি ঝুলছিল। উর্ধ্বতন অনুমোদনের অভাবে আজও দাবিকৃত অর্থ আদায় হয়নি। এ নিয়ে উচ্চ আদালতও উষ্মা প্রকাশ করে জানতে চেয়েছিল দুদক, এনবিআর সবাই নীরব কেন? গ্যালাক্সির কর্পোরেট ভবনে ঢুকলেই চোখে পড়ে রাজনীতিকদের সাথে তোলা ছবি। কখনো সালমান এফ রহমানের পাশে ওয়ালিদ, কখনো ইনুর পাশে তার আত্মীয় বা স্ত্রীর উপস্থিতি। এসব ছবি ব্যবহার করে একাধিকবার কর মওকুফ, লাইসেন্স, অনুমোদন এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহানুভূতিও আদায় করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।


ওয়ালিদের স্ত্রী মেরিন আহমেদ, কন্যা ওয়ামিয়া রওয়ার ওয়ালিদ এবং আত্মীয় শামসুদ্দিন চৌধুরী মিনার এরা প্রত্যেকেই গ্যালাক্সি গ্রুপের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে বড় পদে আসীন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও কর ফাঁকির প্রমাণ থাকার পরেও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি কোনো প্রতিষ্ঠান। কারণ হিসেবে আবার উঠে আসে সেই পুরোনো অভিযোগ উচ্চপর্যায়ের ছায়া। অভিযোগ আছে, শামসুদ্দিন মিনার ও তালুকদার নামে দুজন ব্যক্তিই ওয়ালিদদের আর্থিক অনিয়মের অন্যতম প্রধান কারিগর। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের কাজ করেন বেলায়েত নামের আরেক ব্যক্তি। কর ফাঁকির নথি তৈরি, জাল কাগজপত্র বানানো, ব্যাংকিং ম্যানিপুলেশন সবকিছুর দেখভাল করেন মিজান ও সৌরজ নামের দুই ব্যক্তি।


ওয়ালিদের মালিকানাধীন ‘গ্যালাক্সি এয়ারওয়েজ’ থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়, তার প্রায় পুরোটাই পাচার হয়ে যায় মধ্যপ্রাচ্যে। দেশীয় ব্যাংকিং চ্যানেল নয়, বরং হুন্ডি ব্যবস্থার মাধ্যমেই এসব টাকা চলে যাচ্ছে দুবাইয়ে এমন অভিযোগ তদন্ত রিপোর্টেও উঠে এসেছে।


২০২৪ সালের জুলাই আগস্টে ছাত্র জনতার আন্দোলন যখন সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল, তখন ওই আন্দোলন দমনে ইউসুফ ওয়ালিদ ও তার ডান হাত শামসুদ্দিন মিনার অর্থ ঢেলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু অর্থ নয়, ভাড়াটে লোকজন নিয়োগ ও সহিংসতায় মদদ দেওয়ার অভিযোগে মোহাম্মদপুর থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা (নং: ৩৪/১২৪৪) করা হয় তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংযোগ ও টাকার প্রভাবে তারা আইনের হাতের নাগালের বাইরে থেকে যান। অন্য অভিযুক্তরা পালিয়ে গেলেও ওয়ালিদ গং বহাল তবিয়তে চলাচল করছেন গুলশানের অভিজাত এলাকায়, দিব্যি চালাচ্ছেন অফিস।


বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযান যখন নতুন আশা তৈরি করেছে, তখন ইউসুফ ওয়ালিদ ও তার গ্যালাক্সি সাম্রাজ্যের মতো চক্রগুলোকে আইনের আওতায় আনা না গেলে এ অভিযান শুধু একটি লোক দেখানো প্রচারেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কারণ শুধুই কর ফাঁকি নয় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রের রাজস্বকে কাঁচকলা দেখানো, হুন্ডির মাধ্যমে বৈধ অর্থনীতিকে দুর্বল করে ফেলা, এমনকি গণআন্দোলন দমনে সহিংসতায় অর্থ ঢালার মতো অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিরা যদি নির্বিঘ্নে থেকে যান, তবে দুর্নীতির চক্র কখনোই ভাঙবে না।


এ ব্যাপারে গ্যালাক্সি গ্রুপের মালিক ইউসুফ ওয়ালিদের মুঠো ফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেনি। এমকি ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে উত্তর মেলেনি। 


আরএক্স/