কাগজে বদলি, বাস্তবে বিলম্ব

বিতর্কিত সিদ্ধান্তে প্রশ্নবিদ্ধ ডিপিডিসি


Janobani

মো. বাকি বিল্লাহ

প্রকাশ: ০৫:০৭ পিএম, ১১ই আগস্ট ২০২৫


বিতর্কিত সিদ্ধান্তে প্রশ্নবিদ্ধ ডিপিডিসি
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) সম্প্রতি ১১ জন প্রকৌশলীকে বিভিন্ন ডিভিশনে বদলি করে এক অফিস আদেশ জারি করেছিল, যেখানে বদলিকে “কাজের স্বার্থে” উল্লেখ করা হয়। তবে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে তাদের নতুন কর্মস্থলে যোগদানের সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়ায় এখন প্রশ্ন উঠেছে—এ সিদ্ধান্তে কি প্রশাসনিক শৈথিল্য কাজ করেছে, নাকি নেপথ্যে রয়েছে অন্য কোনো চাপ বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব?


ডিপিডিসির মানবসম্পদ (এইচআর) বিভাগের ম্যানেজার মো. রইচ উদ্দিনের স্বাক্ষরিত প্রথম অফিস আদেশ অনুযায়ী, বদলিকৃত প্রকৌশলীদের ৬ আগস্ট ২০২৫-এর মধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে বলা হয়। 


আদেশে আরও বলা হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যোগদান না করলে ৭ আগস্ট সকাল থেকে তাদের বর্তমান কর্মস্থল থেকে অবমুক্ত বলে গণ্য করা হবে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, ঠিক ৬ আগস্ট তারিখেই (যেদিন যোগদানের শেষ দিন) আরেকটি অফিস আদেশ জারি করে পূর্বের সিদ্ধান্ত আংশিক পরিবর্তন করা হয়। স্মারক নম্বর: ২৭.৮৭.০০০০.০০০.৪০৪.১৯.০০১১.২০.৯৬৬ অনুসারে জানানো হয় যোগদানের সময়সীমা এক মাস বাড়িয়ে ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত করা হয়েছে। 


একইসঙ্গে সতর্ক করে বলা হয়, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে যোগদান না করলে ৮ সেপ্টেম্বর থেকে বর্তমান কর্মস্থল হতে অবমুক্ত বলে গণ্য হবেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।


বদলিকৃত ১১ প্রকৌশলীর মধ্যে ৪ জন উপ-বিভাগীয় ও ৭ জন সহকারী প্রকৌশলী রয়েছেন।


তালিকা নিচে দেওয়া হলো-উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী: আবু হায়াত মো. মোস্তাজির ডেমরা → সাতমসজিদ মোহাম্মদ শাহানুর রশীদ — তেজগাঁও → কামরাঙ্গিরচর, মোঃ শহিদুল ইসলাম-কামরাঙ্গিরচর → তেজগাঁও, মোঃ সাজেদুল ইসলাম সোহাগ- সাতমসজিদ → মিটারিংয়ে (তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর দপ্তরে)। সহকারী প্রকৌশলী: মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির- লালবাগ → কাজলা, অভিজিত দেওয়ানজি- বংশাল → বাসাবো, হোসাইন মোহাম্মদ হেলাল-কাজলা → ডেমরা, মোঃ আব্দুল্লাহ আল হাদী - রমনা → কাকরাইল, মাহফুজুর রহমান -বাংলাবাজার → লালবাগ, রাফাত বিন মল্লিক বাসাবো → বংশাল, মো. রাকিবুল ইসলাম সরকার - কাকরাইল → রমনা। 


ডিপিডিসির প্রথম অফিস আদেশে বদলিকে ‘কাজের স্বার্থে’ উল্লেখ করা হলেও সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়ায় সিদ্ধান্তটির যুক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্টরা।


তাদের মতে, যদি প্রকৃতপক্ষে জরুরি প্রয়োজনে বদলি করা হয়ে থাকে, তাহলে মাত্র সাত দিনের ব্যবধানে সময় বাড়ানোর যৌক্তিকতা কী? ডিপিডিসির কোনো কর্মকর্তা এই বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছে, কিছু প্রকৌশলী পারিবারিক বা ব্যক্তিগত কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যোগদানে অপারগতা প্রকাশ করেন। তাদের আবেদনের ভিত্তিতেই সময় বাড়ানো হয়।


তবে এই ব্যাখ্যা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, এটা ডিপিডিসিতে নতুন কিছু নয়। সকালে বদলি, বিকেলে বাতিলএমন নজির বহুবার ঘটেছে। কিছু প্রকৌশলী নিজেদের সুবিধামতো বদলি ঠেকাতে প্রভাবশালী মহলের শরণাপন্ন হন। এখানেও হয়তো সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে।


বিদ্যুৎ বিতরণে গতি ও মাঠপর্যায়ে দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই ধরনের বদলি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে। তবে হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন প্রতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।


বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ প্রশাসন বিশ্লেষক বলেন, যদি বদলি সত্যিই কাজের প্রয়োজনে হয়ে থাকে, তাহলে সিদ্ধান্তে এমন দোদুল্যমানতা গ্রহণযোগ্য নয়। এতে বদলি প্রক্রিয়ার ওপর অনাস্থা তৈরি হয় এবং মাঠপর্যায়ে কর্মদক্ষতার পরিবর্তে বিভ্রান্তি ও চাপ বাড়ে।


কেউ কেউ মনে করছেন, এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রশাসনিক আলস্য, ভেতরের লবিং ও রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করছে। কারণ, একবার অফিস আদেশ জারি হওয়ার পর তা এক সপ্তাহের ব্যবধানে সংশোধন করার ঘটনা নিছক ‘পারিবারিক সমস্যা’র কারণে নয়।


এক বিদ্যুৎ কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, ডিপিডিসিতে যে কোনো বদলির পেছনে একাধিক পক্ষের স্বার্থ জড়িত থাকে। কোথাও না কোথাও কারও সুবিধা না হলেই সময় বাড়ানো হয় বা আদেশ বাতিল হয়।


ডিপিডিসির এই বদলি নাটক নতুন কিছু নয়। তবে বারবার বদলির আদেশ জারি ও পরিবর্তনের ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে প্রতিষ্ঠান কি নীতিনিষ্ঠভাবে পরিচালিত হচ্ছে, নাকি অভ্যন্তরীণ চাপ ও প্রভাবের কাছে নীতিমালা বারবার মাথা নিচু করছে?


প্রশ্ন এখন একটাইনপ্রশাসনিক সিদ্ধান্ত কি আদৌ স্বাধীনভাবে নেওয়া হচ্ছে, নাকি প্রকৌশলীদের বদলি হয়ে উঠেছে ভেতরের এক লুকোচুরির খেলা?


এ ব্যাপারে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) নূর আহমদকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।


এ ব্যাপারে  ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) নির্বাহী পরিচালক (এডমিন এন্ড এইচ আর) সোনা মনি চাকমা বলেন, আমি এ বিষয় জানি না। এমডি স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ ছাড়া আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয় নাই।   


আরএক্স/