স্বৈরাচারের দোসর তানভীরের ‘স্বজনপ্রীতি’ দুর্নীতির পাহাড়
মো. রুবেল হোসেন
প্রকাশ: ০৫:৪১ পিএম, ১১ই আগস্ট ২০২৫

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (বিআইএম), যা শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বর্তমানে এক আলোচিত ও বিতর্কিত দুর্নীতির অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। সংস্থাটির ‘শক্তিশালীকরণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প’-এর পরিচালক তানভীর হোসাইনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং জবাবহীন সম্পদ বৃদ্ধির গুরুতর অভিযোগ উঠলেও, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এই নিষ্ক্রিয়তা প্রশাসন এবং দুর্নীতিবিরোধী কাঠামোর কার্যকারিতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তুলেছে।
প্রকল্প পরিচিতি ও তানভীর হোসাইনের উত্থান: ‘শক্তিশালীকরণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প’ মূলত বিআইএম-এর অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আধুনিকায়ন ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয়। লক্ষ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদিত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে শুরু থেকেই ছিল একাধিক অনিয়মের অভিযোগ। তানভীর হোসাইন, যিনি প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে প্রেষণে উপ-প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন, অভিযোগ অনুযায়ী, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পরবর্তীতে প্রকল্প পরিচালকের পদ দখল করেন। এখান থেকেই শুরু হয় একের পর এক স্বজনপ্রীতির নজির এবং সরকারি অর্থের অপচয়।
স্বজনপ্রীতি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনিয়ম: তানভীর হোসাইনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তার বেশিরভাগই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ ভাগিয়ে দেওয়া এবং সরকারি অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে সম্পর্কিত।
অভিযোগকারী মো. রইসুল ইসলাম, যিনি নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত ঠিকাদারদের একজন প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করেছেন, সম্প্রতি দুদকে একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে: তানভীর হোসাইন তার মায়ের নামে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান ‘হালিমা সিদ্দিকা ট্রেডার্স’ এবং ভাইয়ের মালিকানাধীন ‘সরদার ট্রেডার্স’-এর মাধ্যমে বিআইএম-এর বিভিন্ন নির্মাণকাজের কাজ ভাগিয়ে নেন। প্রকল্প অফিসের থাই অ্যালুমিনিয়াম, টাইলস ও রংয়ের কাজ দেওয়া হয় ‘সিকো ইন্টারন্যাশনাল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, যার আড়ালে প্রকৃতপক্ষে রয়েছেন তানভীর হোসাইন নিজেই। এভাবে নিজের পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে সরকারি টেন্ডার প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করে কোটি কোটি টাকার কাজ নিজ নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হয়।
ই-জিপি কাজের অনিয়ম: একাধিক ই-জিপি (ইলেকট্রনিক গভার্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) আইডি-র মাধ্যমে দেওয়া কাজগুলোতেও রয়েছে অনিয়মের প্রমাণ: ই-জিপি আইডি: ৮৩০৫৬৮ – টাইলস ও রংয়ের কাজ (মূল্য: ৯৫,৯৬,০০০ টাকা)। এই কাজ আংশিক বাস্তবায়ন হলেও, পুরো বিল পরিশোধ করা হয়। ই-জিপি আইডি: ৮৮৫৫৪৬ প্রকল্পে বাউন্ডারি ওয়ালের কাজের বদলে কেবল রক্ষণাবেক্ষণমূলক কাজ করা হয়। ই-জিপি আইডি: ৮৮৩৬৯৭ অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজেও একই ধরনের অনিয়ম। কাজের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময় ও মান অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়িত না হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ বিল পরিশোধ করা হয়, যা সরকারি অর্থ লোপাটের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
দুর্নীতির টাকায় বিলাসবহুল সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ: অভিযোগে আরও বলা হয়, এই অনিয়ম ও দুর্নীতির অর্থ দিয়ে তানভীর হোসাইন ঢাকার অভিজাত এলাকায় একাধিক বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করেছেন। এসব স্থাপনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ফ্ল্যাট: ৩০৭/১/বি/২, ভবন-১, ফ্ল্যাট-৮/এইচ, পিরেরবাগ, মিরপুর, ঢাকা অন্যান্য ভবন: ড্রিম টাওয়ার, গার্ডেন টাওয়ার, লেক ভিউ, রিলায়েন্স নিবাস (আদাবর) এই সম্পদসমূহ তার ঘোষিত আয় ও সরকারি চাকরির বেতন কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে – কীভাবে তিনি এত সম্পদের মালিক হলেন?
দুদক ও প্রশাসনের নিরবতা: সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এতসব অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত দুদক বা শিল্প মন্ত্রণালয় কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে প্রায় মাসখানেক আগে। নিয়ম অনুযায়ী প্রাথমিক অনুসন্ধান করে তদন্ত শুরু করার কথা থাকলেও, এখনও কোনো নোটিশ বা সাক্ষাৎকার আহ্বান করা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তানভীর হোসাইনের বিরুদ্ধে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ থাকার পরও যদি তদন্ত শুরু না হয়, তাহলে তা দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ করবে।
ক্ষতিগ্রস্ত ঠিকাদারদের অভিযোগ ও হতাশা: দুর্নীতির কারণে প্রকৃত ও যোগ্য ঠিকাদাররা কাজ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে একজন বলেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ছিল না। পূর্বনির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের হাতে কাজ চলে গেছে। আমরা শুধু ফর্ম পূরণ করে বসে ছিলাম।
এছাড়া, কয়েকজন ঠিকাদার জানান, কাজের গুণগতমান ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের এবং প্রকল্পের উপকারভোগীরাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
গণমাধ্যমের ভূমিকা ও জনসচেতনতা: দৈনিক জনবাণীসহ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে এই দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বিস্তারিতভাবে প্রকল্পের কাজ, ব্যয় ও সম্পদের তথ্য তুলে ধরা হয়। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।
জনমনে প্রশ্ন উঠছে, যদি গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ ও সরাসরি দুদকে দেওয়া অভিযোগেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কী?
বাংলাদেশে সরকারি প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু যখন সেই অভিযোগের সঙ্গে সুস্পষ্ট তথ্য, প্রকল্প আইডি, প্রতিষ্ঠানের নাম ও সম্পদের অবস্থান উল্লেখ থাকে, তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরবতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এই ঘটনায় যেমন প্রশাসনিক ব্যর্থতা রয়েছে, তেমনি নৈতিক দিক থেকেও এটি দুর্ভাগ্যজনক।
তানভীর হোসাইনকে ঘিরে বিআইএম প্রকল্পে যেভাবে অনিয়ম ও আত্মীয়কেন্দ্রিক ঠিকাদারির অভিযোগ উঠেছে, তা শুধু একটি প্রকল্প নয়—পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতি প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। দুদক যদি সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে ভবিষ্যতে আরও প্রকল্প দুর্নীতির ঝুঁকিতে পড়বে। একই সঙ্গে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রতিশ্রুতিও ব্যর্থ প্রমাণিত হবে।
এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-পরিচালক(জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম বলেন, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়লে যাছাইবাছাই করা হয়। তার পরে অনুসন্ধানে সিন্ধান্ত নেওয়ো হয়। দুদকে অনুসন্ধানী চোখে যারা দুর্নীতিবাজ কেউ ছাড় যাবে না।
বিআইএম শক্তিশালী করণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক তানভীর হোসাইনের নিটক দুর্নীতি দমন কমিশনে তার বিরুদ্ধে জমা পড়া অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফনে জানতে চাইলে তিনি জনবাণীকে বলেন, 'আপনার কোনকিছু জানার থাকলে অফিসে আসেন, সরাসরি বসে কথা বলে সমাধান করবো'। এই বলে মুঠোফনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।
আরএক্স/