ডেসকোর নিয়োগের চুড়ান্ত তালিকায় স্বৈরাচারের দোসররা


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ০৪:২৪ পিএম, ১৮ই আগস্ট ২০২৫


ডেসকোর নিয়োগের চুড়ান্ত তালিকায় স্বৈরাচারের দোসররা
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া

ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো)নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ঘিরে আবারও তীব্র বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পাওয়া তিন প্রার্থী প্রকৌশলী মো. রাশিদুর রহমান, প্রকৌশলী মো. মনিরুল ইসলাম এবং প্রকৌশলী মির্জা আবু নাসের—এর মধ্যে অন্তত দু’জনকে ঘিরে অভিযোগ উঠেছে, তারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করেছেন।


এর পাশাপাশি নতুন একটি চাঞ্চল্যকর অভিযোগ সামনে এসেছে ডেসকোর নির্বাহী পরিচালকের চেয়ারে বসতে নাকি ১০ কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) লিখিতভাবে জমা পড়েছে বলে অভ্যন্তরীণ সূত্র নিশ্চিত করেছে। ফলে প্রশ্ন জেগেছে এই নিয়োগ কি সত্যিই মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে হচ্ছে, নাকি ঘুষ ও রাজনৈতিক পরিচয়ই হয়ে উঠছে চূড়ান্ত নিয়ামক?


নিয়োগ প্রক্রিয়ার পটভূমি: গত ৯ আগস্ট লিখিত পরীক্ষা, প্রেজেন্টেশন এবং মৌখিক পরীক্ষা শেষে ছয়জন প্রার্থীর মেধাতালিকা তৈরি করে ডেসকোর নিয়োগ কমিটি। সেখান থেকে শীর্ষ তিনজনের নাম বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা হয়। বোর্ড তাদের অনুমোদন দিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠিয়েছে। এখান থেকে একজনকে ৩ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। কাগজে-কলমে প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ মনে হলেও অন্তরালে চলেছে তদবির ও ঘুষ বাণিজ্য। বিদ্যুৎ বিভাগের উপদেষ্টার অনুমোদন পেলেই নিয়োগ সম্পন্ন হবে। আর সেই চূড়ান্ত অনুমোদন নিয়েই এখন চলছে নানা দোদুল্যমানতা ও সন্দেহ।


প্রকৌশলী মো. রাশিদুর রহমান: তালিকার শীর্ষে রয়েছেন ডেসকোর প্রধান প্রকৌশলী (এস অ্যান্ড ডি অপারেশন সাউথ ও সেন্ট্রাল জোন) মো. রাশিদুর রহমান। তাঁর কর্মজীবন শুরু একটি কনসালটেন্সি ফার্মের আওতায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে। ২০০১ সালে তিনি সিএসও পদে ডেসকোতে যোগ দেন। বিএনপি সরকারের সময়ে নিয়োগ পেলেও অভিযোগ রয়েছে, তাঁর রাজনৈতিক ঝোঁক সবসময় আওয়ামী লীগের দিকেই ছিল। সহকর্মী ও অধীনস্থদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, গ্রাহকসেবায় অনীহা ও সিন্ডিকেট নির্ভরতা এসব অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ডেসকোর ভেতরে প্রচলিত আছে, রাশিদুর রহমানকে তালিকার শীর্ষে আনার পেছনেও ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার প্রত্যক্ষ তদবির রয়েছে।


তবে রাশিদুর রহমান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে নয়, আমি মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই ডেসকোতে চাকরি করছি। আমার বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তার কোনো সত্যতা নেই।


কৌশলী মো. মনিরুল ইসলাম:  মেধাতালিকার দ্বিতীয় স্থানে আছেন প্রকৌশলী মো. মনিরুল ইসলাম। তিনি কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির প্রধান প্রকৌশলী (প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন) ছিলেন। তবে ২০২৩ সালে মাত্র ৪৯ বছর বয়সেই তাঁর চুক্তি নবায়ন করা হয়নি।


কারণ হিসেবে জানা যায়, তৎকালীন এমডি আব্দুল মোতালিব ও নির্বাহী পরিচালক (প্রকল্প) আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেটের অনিয়মে বাধা দিয়েছিলেন তিনি। তারা ভুয়া প্রকল্প দেখানো ও ব্যয় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলার চেষ্টা করলে মনিরুল তাতে আপত্তি জানান। এর জের ধরে তিনি চাকরি হারান।


তিনি বলেন, আমার চাকরির চুক্তি বাড়ানো হয়নি কেবল দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে। এটা ছিল অন্যায় আচরণ।


তাঁর নাম তালিকায় আসা নিয়ে ভেতরে বাইরে প্রশ্ন উঠেছে তিনি কি সত্যিই মেধা ও সততার কারণে সুযোগ পাচ্ছেন, নাকি রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে তাঁর নাম রাখা হয়েছে।


 প্রকৌশলী মির্জা আবু নাসের : তালিকার তৃতীয় নাম মির্জা আবু নাসের। প্রথম জীবনে তিনি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে চাকরি করলেও ২০০১ সালের জানুয়ারিতে ডেসকোতে অফিসার পদে যোগ দেন। ২০০৬ সালে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী, ২০১১ সালে নির্বাহী প্রকৌশলী এবং ২০১৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে উন্নীত হন। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি পদোন্নতির পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করেছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের সুপারিশে তিনি পদোন্নতি পান বলে সহকর্মীদের দাবি। তাঁর নাম তালিকায় আসাকে অনেকেই ‘রাজনৈতিক বিনিয়োগের রিটার্ন’ বলে মন্তব্য করছেন।


আবু নাসের অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার পদোন্নতিতে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব ছিল না। আমি কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না।


ডেসকোর অভ্যন্তরীণ সূত্রের দাবি : ডেসকোর ভেতরের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অন্তত দু’জন প্রার্থীর পদোন্নতি ও বর্তমান অবস্থান স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক তদবিরের ফল। বিশেষ করে আবু নাসেরের ক্ষেত্রে সিনিয়রিটি তালিকা পরিবর্তন করে তাঁকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ঘটনা প্রমাণসাপেক্ষ।


তারা বলেন, যোগ্য অনেক কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও কেন বিতর্কিত প্রার্থীদেরই তালিকায় রাখা হলো? এর পেছনে ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া আর কী থাকতে পারে।


১০ কোটি টাকার ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ: অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, নির্বাহী পরিচালক পদে বসতে প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে। আলোচনায় সবচেয়ে বেশি এসেছে ১০ কোটি টাকা ঘুষের অভিযোগ। প্রার্থীদের ঘনিষ্ঠজনদের মাধ্যমে এই টাকা হাতবদল হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।


এই অভিযোগ ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এ জমা পড়েছে। দুদক কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য না করলেও বিদ্যুৎ বিভাগের ভেতরে এ নিয়ে চরম অস্বস্তি বিরাজ করছে। একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন,নির্বাহী পরিচালক পদকে ঘিরে এমন প্রকাশ্য ঘুষ বাণিজ্য আগে দেখা যায়নি। এটি প্রমাণ করে, রাজনৈতিক দোসরদের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।


বিদ্যুৎ খাতে রাজনৈতিক প্রভাবের দীর্ঘ ইতিহাস: বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত বরাবরই রাজনৈতিক প্রভাব ও লবিবাজির শিকার। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), ডেসকো, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার, পল্লী বিদ্যুৎ—প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই নিয়োগ ও পদোন্নতিতে ক্ষমতাসীন দলের ছায়া গভীর।


২০০৯ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ খাতে বিপুল বিনিয়োগ করে। কিন্তু সেই বিনিয়োগের পাশাপাশি বাড়তে থাকে দুর্নীতি, সিন্ডিকেট ও নিয়োগে পক্ষপাতিত্ব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ সেবার মান উন্নয়নের বদলে এসব কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো অদক্ষতায় জর্জরিত হচ্ছে।


একজন বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞ বলেন, ডেসকোর নির্বাহী পরিচালক একটি কৌশলগত পদ। এখানে যদি ঘুষ বা রাজনৈতিক আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানটি আরও দুর্বল হবে।


আরেকজন প্রশাসনিক বিশ্লেষক মনে করেন, আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, মেধাবীদের বাদ দিয়ে রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠদের প্রমোট করা হয়। এর ফলে দুর্নীতি, অদক্ষতা ও জনগণের আস্থা হ্রাস পায়। ডেসকোর বর্তমান তালিকাই সেই ধারাবাহিকতার প্রতিফলন।


নিয়োগ প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ: ডেসকো কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, লিখিত পরীক্ষা, প্রেজেন্টেশন এবং মৌখিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতেই প্রার্থী বাছাই করা হয়েছে। তবে অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, প্রশ্ন তৈরিতে ও মূল্যায়নে প্রভাবশালী মহলের প্রভাব ছিল। শোনা যাচ্ছে, বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো তালিকার নামগুলো আগে থেকেই নিশ্চিত ছিল। নিয়োগ প্রক্রিয়াটি কেবল আনুষ্ঠানিকতা পূরণের জন্য করা হয়েছে।


ভবিষ্যৎ প্রভাব: যদি ঘুষ ও রাজনৈতিক তদবিরের মাধ্যমে নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে তার প্রভাব পড়বে ডেসকোর কার্যক্রমে। বিদ্যুৎ সরবরাহের গুণগত মান কমবে, প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা হারাবে, দুর্নীতি বাড়বে। কোটি কোটি গ্রাহকের সেবায় দক্ষতা নয়, বরং রাজনৈতিক প্রভাব ও আর্থিক স্বার্থ কাজ করবে। এতে জনআস্থা আরও কমে যাবে।


ডেসকোর নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ প্রক্রিয়া ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের বিষয় নয় এটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের সামগ্রিক দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। মেধা নয়, ঘুষ ও রাজনৈতিক পরিচয় যদি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের নিয়ামক হয়, তবে প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে যাবে। এখন সবার দৃষ্টি বিদ্যুৎ বিভাগের উপদেষ্টার দিকে। তিনি কি দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করবেন, নাকি আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী দোসরদের জন্য আরেকটি বিতর্কিত নিয়োগের নজির যোগ করবেন।


আরএক্স/