নেসকোর এমডি নিয়োগে চলছে টাকার খেলা


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ১২:৩৪ পিএম, ১৯শে আগস্ট ২০২৫


নেসকোর এমডি নিয়োগে চলছে টাকার খেলা
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া।

রাজধানীর রেলভবনের  সেমিনার কক্ষে ১০ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) শীর্ষ পদে নিয়োগের ভাইভা পরীক্ষা। তিন প্রার্থী অংশ নেন। পরীক্ষার ফলাফলে প্রথম হন একজন, দ্বিতীয় হন আরেকজন, তৃতীয় হন প্রকৌশলী তোফাজ্জল হোসেন প্রামাণিক। অথচ আলোচনায় এখন তিনি-ই এগিয়ে। নানা দেনদরবার, ঘুষ-কেলেঙ্কারি আর সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে যিনি দীর্ঘদিন ছিলেন সমালোচিত, সেই প্রকৌশলীই এবার নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হতে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) এ নিয়ে লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এই ঘটনার পর থেকেই বিদ্যুৎ খাতে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছেযোগ্যতা নয়, বরং টাকার জোরেই কি শীর্ষ পদে নিয়োগ হচ্ছে।


শূন্য পদে নতুন দৌড়ঝাঁপ : গত ১২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে এমডি পদ ছাড়েন নেসকোর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকিউল ইসলাম। তারপর থেকে দীর্ঘ সাত মাস পদটি শূন্য পড়ে থাকে। অবশেষে বিদ্যুৎ বিভাগ একটি নিয়োগ বোর্ড গঠন করে ১০ আগস্ট তিনজন প্রার্থীর ভাইভা নেয়। ফলাফলে প্রথম হন মো. শামসুল আলম, দ্বিতীয় মো. আশরাফুল ইসলাম এবং তৃতীয় হন মো. তোফাজ্জল হোসেন প্রামাণিক। স্বাভাবিক নিয়মে প্রথম প্রার্থী নিয়োগ পাওয়ার কথা থাকলেও এখন আলোচনায় রয়েছেন তৃতীয় প্রার্থী তোফাজ্জল। অভিযোগ উঠেছে, টাকার ব্যাগ আর ক্ষমতার প্রভাবে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন।


বিতর্কিত অতীতের প্রকৌশলী: তোফাজ্জল হোসেন প্রামাণিক বর্তমানে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) কুমিল্লা অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। চাকরিজীবনে তিনি ছিলেন নানা বিতর্কের কেন্দ্রে।


ভুতুড়ে বিল কেলেঙ্কারি: তার তত্ত্বাবধানে কুমিল্লা অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পরে পুনরায় সংযোগ দিয়ে অন্তত ৯০০ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।


টেন্ডার বাণিজ্য: বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন প্রকল্পে তার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। টেন্ডার বাণিজ্য, ঠিকাদারি অনিয়ম আর ঘুষ বাণিজ্য ছিল ওপেন সিক্রেট।


ঘুষের অভিযোগ: কুমিল্লার ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন ওয়াজেদ অভিযোগ করেন, “’তোফাজ্জল হোসেন টাকা ছাড়া কিছু বোঝেন না। আমাকে জিম্মি করে ৩ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। আমার এক পরিচিত প্রতিষ্ঠান থেকেও ৫ লাখ টাকা আদায় করেছেন।’


স্বৈরাচারের দোসর’ তকমা: বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক সূত্র জানায়, নেসকোর সাবেক এমডি জাকিউল ইসলামের সময়ও নানা অনিয়ম ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়োগ ও প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রেখেছিল। তিনি ছিলেন তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নজরুল হামিদ বিপুর ঘনিষ্ঠ। ফলে পছন্দের ঠিকাদাররা কাজ পেতেন সহজেই।


বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘নেসকোর এমডি পদে এখন যাদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তাদের অনেকে আওয়ামী সরকারের ‘স্বৈরাচারের দোসর’ হিসেবে চিহ্নিত। তোফাজ্জল হোসেনও সেই তালিকায়। অর্থ ও প্রভাব খাটিয়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন।’


দুদকে লিখিত অভিযোগ: তোফাজ্জল হোসেন প্রামাণিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি দীর্ঘদিন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দুর্নীতি চালিয়েছেন। কুমিল্লা অঞ্চলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও পুনঃসংযোগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। নেসকোর এমডি হতে তিনি বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে লেনদেন শুরু করেছেন।


দুদক সূত্র জানায়, অভিযোগগুলো যাচাই করা হচ্ছে। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই যদি তদন্ত শেষ না হয়, তাহলে বিতর্কিত ব্যক্তিই এমডি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যেতে পারেন।


মন্ত্রণালয়ের নীরবতা : এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তায়ও কোনো উত্তর দেননি। ফলে সরকারের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী মহলের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেছে।


অভিযুক্তের বক্তব্য: যোগাযোগ করা হলে প্রকৌশলী তোফাজ্জল হোসেন প্রামাণিক বলেন, আমি কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নই। এমন কথা বলেই তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন।


বিদ্যুৎ খাতে পুরনো চেহারা: বিদ্যুৎ খাতে দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ ও পদায়নে স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে এমডি বা শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদে রাজনৈতিক প্রভাব ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ নতুন নয়।


সাবেক জাকিউল ইসলামের আমলে যেমন পছন্দের ঠিকাদাররা কাজ পেতেন, তেমনি আবারও সেই পুরনো চেহারায় ফিরছে নেসকো। একজন যোগ্য প্রার্থী ভাইভায় প্রথম হলেও শেষ পর্যন্ত টাকা ও প্রভাবশালী মহলের দোসরই এমডি হচ্ছেন এমন শঙ্কা বাড়ছে।


বিশেষজ্ঞদের মত: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন,’বিদ্যুৎ খাত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত। এখানে যদি অযোগ্য বা দুর্নীতিবাজরা নেতৃত্বে আসে, তাহলে দেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা না থাকলে জনগণের ভোগান্তি আরও বাড়বে।’


অন্যদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন):এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে অস্বচ্ছ নিয়োগ মানেই সেবায় অস্বচ্ছতা। এমডি পদে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতায় শীর্ষে থাকা প্রার্থীকে বাদ দিয়ে তৃতীয় জনকে নিয়োগ দেওয়া হলে এটি হবে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বৈধতা দেওয়া।’


জনগণের ক্ষোভ ও শঙ্কা:  গ্রাহকদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। কুমিল্লার এক ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,’বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে আমাদের বারবার ঘুষ দিতে হয়। এমডি যদি এমন বিতর্কিত হয়, তাহলে দুর্নীতি আরও বেড়ে যাবে।’


রংপুর অঞ্চলের আরেক গ্রাহক জানান, ‘বিদ্যুতের বিল, সংযোগ আর মিটার—সব জায়গায়ই ঝামেলা। এবার আবার এমডি পদে দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’


সামনে কী অপেক্ষা করছে: সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, তোফাজ্জল হোসেন প্রামাণিকই নেসকোর এমডি হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে। দুদকে অভিযোগ থাকলেও মন্ত্রণালয় নীরব। অভিযোগকারীরা শঙ্কিত, তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই যদি নিয়োগ হয়ে যায়, তাহলে আবারও বিদ্যুৎ খাত অস্বচ্ছতার চক্রে আটকে পড়বে।


নেসকোর এমডি পদে নিয়োগকে ঘিরে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে, তা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নয় পুরো বিদ্যুৎ খাতের জন্য সতর্কবার্তা। যোগ্যতা ও মেধার পরিবর্তে যদি টাকার জোরে শীর্ষ পদে বসা যায়, তবে খাতটির উন্নয়ন নয়, বরং ভোগান্তি আরও বাড়বে। দেশের জনগণ ইতিমধ্যেই বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল, অনিয়ম আর দুর্নীতিতে ক্লান্ত। এখন আবার শীর্ষ পদে বিতর্কিত নিয়োগ এ খাতকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা সময়ই বলে দেবে।


আরএক্স/