হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিনের ঘুষের দোকান
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ০৩:২০ পিএম, ২১শে আগস্ট ২০২৫

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) মাতুয়াইল ডিভিশনে বিদ্যুৎ সংযোগকে কেন্দ্র করে চলছে ঘুষ ও অনিয়মের মহোৎসব। নিয়ম অনুযায়ী যেসব স্থাপনায় উচ্চচাপ (এইচটি) সংযোগ দেওয়ার কথা, সেগুলোকে ঘুষের বিনিময়ে নিম্নচাপে (এলটি) সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এতে শুধু গ্রাহক প্রতারিত হচ্ছেন না, সরকারের রাজস্বও হারিয়ে যাচ্ছে কোটি টাকায়। অভিযোগ উঠেছে, নির্বাহী প্রকৌশলী মো.হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট পুরো ডিভিশনে ঘুষ বাণিজ্য চালাচ্ছে। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এবং উপ-সহকারী প্রকৌশলীরাও। এক গ্রাহক ইতিমধ্যেই দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন। অথচ কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে এখন পরস্পরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন।
নিয়ম ভেঙে সংযোগ: ডিপিডিসির নীতিমালা অনুযায়ী, আবাসিক, বাণিজ্যিক কিংবা শিল্প স্থাপনায় ৮০ কিলোওয়াটের বেশি লোড হলে তা উচ্চচাপ বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় পড়ে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহককে নিজস্ব খরচে ট্রান্সফরমার, সুইচগিয়ার, পিএফআই প্ল্যান্ট ও এসটি মিটার বসাতে হয়। একইসঙ্গে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্সিং দপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু মাতুয়াইল ডিভিশনের আওতাধীন ফতুল্লার গিরিধারা এলাকার বাসিন্দা মিঠু আহম্মেদ তার নয়তলা ভবনে ৩২টি ফ্ল্যাট ও একটি মাদার মিটারের জন্য ৭৬ কিলোওয়াট লোডের আবেদন করলেও প্রথমে তাকে উচ্চচাপ সংযোগ নিতে চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠিতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, স্থাপনার মোট প্রয়োজনীয় লোড দাঁড়ায় ৯৩ কিলোওয়াট যা উচ্চচাপ সংযোগ ছাড়া দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে পরবর্তীতে ৫ লাখ টাকার আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে একই ভবনে নিম্নচাপে সংযোগ দেওয়া হয়। এ নিয়ে গ্রাহক দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিতভাবে জানান।
কে কোন ভূমিকায়: সিন্ডিকেটের চিত্র, অভিযোগ অনুযায়ী, ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলামের নির্দেশেই এসব লেনদেন ভাগাভাগি হয়। সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্যরা হলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. হানিফ, নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হেলাল উদ্দিন, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী খায়রুল বাশার, উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবুল বাশার তালুকদার। এরা একযোগে গ্রাহকদের নিয়মবহির্ভূত প্রক্রিয়ায় সংযোগ দিতে চাপ সৃষ্টি করেন এবং বিভিন্ন অজুহাতে ঘুষ আদায় করেন। সূত্র বলছে, অফিসিয়াল কাগজপত্রে ইচ্ছাকৃত ভুল দেখিয়ে পরবর্তীতে সেটি ম্যানেজ করার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়।
কর্মকর্তাদের বক্তব্যে দায় এড়ানো: উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী খায়রুল বাশার জানিয়েছেন, চিঠিতে সংখ্যাগত ভুল ছিল। তবে ঘুষের বিষয়ে তিনি দায় চাপিয়েছেন সহকর্মীদের ওপর। উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবুল বাশার তালুকদারও বলেছেন, নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলামের নির্দেশে নির্বাহী প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন নিম্নচাপ সংযোগ দিয়েছেন। এটা সত্য। নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) স্যার বললে না করার সুযোগ নাই। তিনি আবেদন পত্রে সুপারিশও করেন। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. হানিফ উদ্দিন আবার দাবি করেছেন, সবকিছু নিয়ম অনুযায়ী অনুমোদিত হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাহী প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন বলেন, নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) স্যারের নির্দেশ সংযোগ দিয়েছি। তবে ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে সরাসরি কোনো জবাব দেননি।
ইতিহাসও প্রশ্নবিদ্ধ: সূত্র জানায়, হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে অতীতেও নানা অভিযোগ ছিল। ২০১৯-২০২০ সালে আদাবর ডিভিশনে দায়িত্ব পালনকালে গ্রাহক হয়রানি, টাকা ছাড়া সংযোগ না দেওয়া এবং নিয়ম ভেঙে নিম্নচাপ সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। গণমাধ্যমে প্রকাশের পর তাকে বদলি করা হয়। বর্তমানে মাতুয়াইলে এসে তিনি নতুন সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন, যেখানে সহযোগী হিসেবে রয়েছেন কয়েকজন প্রকৌশলী।
সিন্ডিকেটের কার্যপদ্ধতি: অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন, সিন্ডিকেট ঘুষের বিনিময়ে বিদ্যুৎ সংযোগে নিয়ম ভেঙে সুবিধা দেয়, অবৈধ লাইন চালায়, মিটার টেম্পারিং করে,গ্রাহকের ডিপোজিটের অর্থেও অনিয়ম করে থাকে। এমনকি ঘুষ পেলে গ্রাহকের নামে উন্নয়ন কাজ দেখিয়ে সংযোগ দেওয়া হয়। এতে একদিকে সিন্ডিকেট মোটা অঙ্কের টাকা পকেটে ভরছে, অন্যদিকে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব।
রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ও চাপ: সিন্ডিকেটের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, হেড অফিসে টাকা দিতে হয়, আবার রাজনৈতিক অনুষ্ঠানেও চাঁদা দিতে হয়। টাকা না কামালে খরচ করব কীভাবে। এমন অবস্থায় স্পষ্ট হচ্ছে, শুধু মাঠপর্যায়ের প্রকৌশলীরাই নয়, এর পেছনে প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়াও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিস্টেমের ভেতরে থেকেই যদি নিয়ম ভাঙা হয়, তাহলে তা রোধ করা প্রায় অসম্ভব। তাই কঠোর নজরদারি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা যথাযথভাবে তদন্ত না করলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে।
মাতুয়াইল ডিভিশনের ঘটনাটি কেবল একটি উদাহরণ। ঢাকার বিভিন্ন ডিভিশনে একইভাবে বিদ্যুৎ সংযোগে নিয়ম ভঙ্গ ও ঘুষ বাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন প্রশ্ন ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ কি এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে, নাকি দায় এড়ানোর সংস্কৃতিই চলতে থাকবে।
এ ব্যাপারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন,’বিদ্যুৎ খাত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত। এখান বেশ কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার নেতৃত্বে চলছে ঘুষ লেনদেন। এতে করে দেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে সেবায় অস্বচ্ছতা। নতুন সংযোগ নিতে গুনতে হয় ঘুষ। দিনে দিনে বাড়ছে ঘুষ লেনদেন। এটি এখন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বৈধতা দেওয়া।
আরএক্স/