বিআইএম প্রকল্প পরিচালকের চেয়ার রক্ষক কালো টাকা


Janobani

মো. রুবেল হোসেন

প্রকাশ: ০১:১০ পিএম, ২৩শে আগস্ট ২০২৫


বিআইএম প্রকল্প পরিচালকের চেয়ার রক্ষক কালো টাকা
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (বিআইএম) শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন দেশের অন্যতম প্রাচীন ও মর্যাদাপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে সুনাম থাকা এই প্রতিষ্ঠান আজ চরম বিতর্কের কেন্দ্রে। প্রতিষ্ঠানটির ‘বিআইএম শক্তিশালীকরণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প’ নিয়ে উঠেছে ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ। কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন প্রকল্প পরিচালক তানভীর হোসাইন। একদিকে কোটি কোটি টাকার তছরুপ, অন্যদিকে রাজনৈতিক রঙ বদলের আশ্চর্য খেলা- সব মিলিয়ে একটি সরকারি প্রকল্প কীভাবে ব্যক্তি স্বার্থে পরিণত হতে পারে, তারই ভয়ঙ্কর উদাহরণ হয়ে উঠেছে এই ঘটনা।


প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল উন্নয়ন, বাস্তবে অনিয়ম: ২০১৮ সালে অনুমোদিত “বিআইএম শক্তিশালীকরণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প”এর মূল লক্ষ্য ছিল বিআইএম-এর অবকাঠামো উন্নয়ন, আধুনিকীকরণ এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্প্রসারণ। এর বাজেট ছিল ৫৪ কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু শুরু থেকেই এ প্রকল্প ঘিরে দেখা দেয় নানা ধরনের অনিয়ম ও অসঙ্গতি।


৫৪ কোটি টাকার কাজ ভাগ হলো ২৬টি খণ্ডে: সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, প্রকল্প পরিচালক তানভীর হোসাইন একক একটি কাজকে ২৬টি ছোট প্যাকেজে ভাগ করেন, যাতে করে সরকারি ক্রয় বিধিমালা (পিপিআর) পাশ কাটিয়ে নিজের মনমতো ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে পারেন। তিনি নিজেই প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিলেন দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে কাজ অনুমোদন পর্যন্ত। এতে প্রশ্ন উঠেছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে।


প্রতিষ্ঠানের বাইরের ঠিকাদার বাদ: তদন্তে উঠে এসেছে, প্রকল্পের বড় অংশের কাজ তিনি দিয়েছেন নিজের মা, ভাই এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মালিকানাধীন তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের হাতে। যেমন: হালিমা সিদ্দিকা ট্রেডার্স (মায়ের নামে),সরদার ট্রেডার্স ( ভাই পরিচালিত),সিকো ইন্টারন্যাশনাল (ঘনিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রতিষ্ঠান)। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে কাজ পাইয়ে দিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।


প্রকল্পে কাজের চেয়ে বিল বেশি: প্রকল্প নথি অনুযায়ী, ভবনের ইন্টেরিয়রে ২২ হাজার বর্গফুট থাই টাইলস বসানোর কথা থাকলেও বাস্তবে বসানো হয়েছে মাত্র ৩৪ হাজার বর্গফুট। রডের হিসেবেও গরমিল ৩৭ টন রড দেখানো হলেও ব্যবহার হয়েছে নামমাত্র। পুরনো দেয়াল প্লাস্টার করেই দেখানো হয়েছে নতুন নির্মাণ, অথচ বিল এসেছে সম্পূর্ণ নতুন নির্মাণের। অভিযোগ আছে, টাইলসের বাজারমূল্য তিনগুণ বাড়িয়ে দেখিয়ে বিল করা হয়েছে।


তদন্তে নেমেছে শিল্প মন্ত্রণালয়, বাধা দিচ্ছেন তানভীর: দৈনিক জনবাণীতে ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশের পরেই বিআইএমে দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ হওয়ার পর শিল্প মন্ত্রণালয় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান: সচিব মো. ওবায়দুর রহমান অন্য দুই সদস্য: অতিরিক্ত সচিব মো. নুরুজ্জামান ও উপসচিব ড. সাইফুল ইসলাম। তবে অভিযোগ উঠেছে, তানভীর হোসাইন বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে তদবির করে তদন্ত কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছেন। এমনকি নিরাপত্তা বাহিনী ও কিছু মিডিয়া হ্যান্ডেলিংয়ের চেষ্টা করছেন বলেও একাধিক সূত্রে জানা গেছে।


রাজনৈতিক লেবাস বদলের খেলা: আরও চমকপ্রদ তথ্য হলো, তানভীর হোসাইন নিজেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলাম সব দলের সাথে সংশ্লিষ্ট বলে প্রচার করেন বিভিন্ন মহলে সুবিধা নেওয়ার জন্য।


কখনো তিনি দাবি করেন আওয়ামী লীগের হাইপ্রোফাইল নেতা, আবার কখনো বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় নেতার আত্মীয় বলে পরিচয় দেন। এমনকি জামায়াত সংশ্লিষ্ট পরিচয় দিয়েও সুবিধা নিয়েছেন বলে একাধিক প্রতিবেদন বলছে। 


তদন্তে বাধা দিতে রাজনৈতিক প্রভাবের অপব্যবহার: তদন্ত কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, তানভীর প্রভাবশালী সাবেক এমপি ও আমলাদের যুক্ত করেছেন তার পক্ষে তদবিরে। তিনি নিয়মিত রাজধানীর অভিজাত রেস্টুরেন্টে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে চলেছেন বলে জানায় একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র।


অফিসে আতঙ্ক, মুখ খুললেই বদলি: বিআইএমে কেউ যদি তানভীর হোসাইনের বিরুদ্ধে মুখ খোলে, তাহলে তাকে বদলির হুমকি বা পদাবনতির ভয় দেখানো হয়। কিছু কর্মকর্তার ফোন কল ফাঁসের ভয় দেখিয়ে নীরব থাকতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি সাংবাদিকদের সঙ্গেও তানভীর আক্রমণাত্মক আচরণ করেছেন একাধিকবার।


কি বলছেন বিশ্লেষকর: টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতির ঘটনা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জবাবদিহির ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে আরও বড় অনিয়ম হবে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক বলেন,এই প্রকল্পে শুধু অর্থ নয়, প্রশাসনিক মূল্যবোধকেও হত্যা করা হয়েছে। দুর্নীতিবাজদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে।


দায় এড়ানো নয়, জবাবদিহি চাই: বিআইএম প্রকল্পে যা ঘটেছে তা শুধু একটি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাত নয় ত,এটি প্রশাসনিক ব্যবস্থার দুর্বলতা, রাজনৈতিক অপব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতার ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত। সরকারের স্বচ্ছতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তব প্রমাণ দিতে হলে, তানভীর হোসাইনের মতো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।


আরএক্স/