ভিক্ষাবৃত্তি পেশাকে নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন

মোহাম্মদ ওয়াহিদ মিরাজ ভিক্ষুক’ শব্দটি শুনলেই মনের মধ্যে এক সময়ে সাধারণত অতি দরিদ্র, রুগ্ন, অন্ধ, পঙ্গু ও পরণে ছেড়া জামা কাপড় এ ধরনের মানুষের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠতো কিন্তু বর্তমান যুগের ভিক্ষুকদের মাঝে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
বিজ্ঞাপন
এদের মধ্যে অধিকাংশের পরনে মোটামুটি ভালো জামা-কাপড়ের পাশাপাশি পকেটে এনড্রয়েড মোবাইল এবং বাসায় বা ব্যাংকে অর্থও জমা থাকে।
অধিকাংশের জন্মভূমিতে জায়গা জমির পাশাপাশি উন্নতমানের বাড়ির সন্ধানও পাওয়া যায়। তাদের থেকে সুদে ঋণ নিয়ে অনেকে ছোট খাট ব্যবসা করার খবরও শোনা যায়। অধিকাংশের খাওয়া দাওয়ায়ও আধুনিকতার ছোঁয়া পরিলক্ষিত হয়। কিছু ভিক্ষুকের সন্তানগণ উন্নতমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত রয়েছে মর্মে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, যা আমাদের দেশে ভবিষ্যতে মঙ্গল বয়ে আনতে পারে।
এ প্রসঙ্গে প্রায় ১ যুগ পূর্বের একটি সত্য ঘটনা যেন না বল্লেই নয়। তৎসময়ে সৈয়দা সারোয়ার জাহান (প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুর রহমান খান রুশ্নির স্ত্রী) চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা (সংগত কারণে নাম প্রকাশ করা হলো না) কর্তৃক চট্টগ্রাম জেলা পরিষদে চিকিৎসার জন্য আর্থিক অনুদান প্রার্থনা করে আবেদন করা হয়। চাকরির সুবাদে এমন মহতী কাজে আমিও জড়িত থাকায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক আমাকে আবেদনকারীর ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়।
বিজ্ঞাপন
অতঃপর আবেদনকারী নগরীর কোর্ট বিল্ডিং এ ভিক্ষা করেন মর্মে জানানোর পরে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশনা অনুযায়ী তাকে অফিসে ডাকা হয়। অতঃপর তার বয়স বিবেচনায় ভিক্ষা কাজে নিরুৎসাহিত করায় তার কর্তৃক আত্মকর্মসংস্থানমূলক কিছু পেলে আর ভিক্ষা করবেন না মর্মে মহোদয়কে জানানো হয়।
এ কথা শোনে তার ইচ্ছা অনুযায়ী জেলা পরিষদের অর্থে তাকে চা-নাস্তা বিক্রি করার জন্য ১টি ভ্যান গাড়ি ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি দেয়া হয়। মাসখানেক পরে তাকে নির্ধারিত জায়গায় না দেখে প্রথমে মনে হলো তার ব্যক্তিগত কোনো সমস্যার কারণে আপাততঃ হয়তো তার ব্যবসা বন্ধ রাখা হয়েছে। এভাবে আরো বেশ কিছু দিন যাওয়ার পরে তাকে পুনরায় অন্য জায়গায় ঐ ভিক্ষুকের কাতারে আবিষ্কার করা হয়।
বিজ্ঞাপন
এ প্রসঙ্গে তার সঙ্গে আলাপকালে বুঝতে পারি, ভিক্ষা করার মধ্যে তেমন কষ্ট বা ঝুঁকি নেই, তার ছেলে-মেয়ের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সংসারের ব্যয়ও অত্যধিক তাই ভিক্ষা পেশায় আয় ছোট খাট ব্যবসায়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি হয় বিধায় তার দ্বারা এমন ছোট ব্যবসা করা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ এতে আয়ের চেয়ে কষ্ট অনেক বেশি হয়।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে উন্নয়নশীল দেশের ন্যায় বন্দর নগরীকে ভিক্ষুক মুক্ত করার জন্য কর্মক্ষম বেশ কিছু ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কয়েক বছর পূর্বে চাকরি দেয়া হলেও চাকরির তুলনায় ভিক্ষা পেশায় আয় বেশি হওয়ায় তাদের মধ্যে অধিকাংশই সে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে মর্মে জানা গেছে।
এতে প্রতীয়মান হয় যে, একবার ভিক্ষা পেশায় আত্মনিয়োগ করার পরে অতীব লোভের কারণে সহজে এ পেশা পরিত্যাগ করা সম্ভব হয়না, বরং এ পেশায় আয় বেশি হওয়ায় অনেকে নিজের সন্তান বা অন্য কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে পঙ্গু করে বা পঙ্গু সাজিয়ে এমন পেশায় নিয়োজিত করে আয় করতে উৎসাহবোধ করছে।
বিজ্ঞাপন
আবার অন্যের পঙ্গু বাচ্চাকে অনেকে ভাড়া নিয়ে এ পেশা চালিয়েও যায়। সাধারণতঃ মুসলিম দেশের মানুষ ধর্মভিরু হওয়ায় একদিকে নেকি লাভ এবং নিজের গোনাহ ক্ষমা পাওয়ার আশায় ভিক্ষা দেয়, আবার অনেকে সমাজে দানশীল হিসেবে পরিচিতি লাভের আশায়ও ভিক্ষা দিয়ে থাকে।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, সমাজে যাদের সম্মান নেই বা সম্মান কম মূলতঃ তারাই ভিক্ষা দিয়ে সম্মান আদায়ের মতো কর্ম করতে পছন্দ করে থাকে। এরা অনেক সময়ে তাদের দানের কথা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের জন্য অর্থ ব্যয় করতেও কার্পণ্য করে না।
বিজ্ঞাপন
আমার জানা মতে দেশসেরা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে এ সংক্রান্ত ব্যঙ্গাত্মক নাটিকা প্রচারপূর্বক এ পেশা বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকার ও জনগণের প্রতি আহবানও জানানো হয়েছে।
বর্তমান যুগে পৃথিবীর সকল দেশেই ভিক্ষাবৃত্তি একটি ঘৃণিত সামাজিক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যে দেশের বিবেকবান মানুষ এমন সম্মানহানিকর কাজটিকে সমর্থন করে।
এরা সাধারণত বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান, স্টেশন, পার্ক, উদ্যান, ফুটপাত, বাজার, খেলার মাঠ, আদালত প্রাঙ্গণ ও বাসা বাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় ভিক্ষা করে থাকে। বিশেষ করে পার্ক ও উদ্যানে বিরাজমান অল্প বয়সের শিশুদের এমনভাবে শিক্ষা দিয়ে ভিক্ষার কাজে ন্যস্ত করা হয় যে, তারা ভিক্ষা না পাওয়া পর্যন্ত পিছু ছাড়বে না, কাপড় ধরে টানাটানি পর্যন্ত করতে থাকে।
বিজ্ঞাপন
বিগত ২৫ জুলাই ২০২৫ তারিখে নগরীর স্টেডিয়াম সংলগ্ন ‘মুক্তমঞ্চ’ চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত জুলাই অভ্যুত্থানের অনুষ্ঠানে ভিক্ষা চাওয়া একটি শিশুকে দেখে চিন্তিত ও লজ্জিত হওয়া ব্যতীত আমার কোনো পথই খোলা ছিল না, কারণ কোনটা কত টাকার নোট তা চেনার বয়স তার হয়নি, প্রাপ্ত অর্থ এক সঙ্গে রাখার বুদ্ধিও তার নেই। অথচ সে একেকজনকে এমনভাবে টাকার জন্য জড়িয়ে ধরছিল যে, তার হাতে থাকা আইসক্রিমের খালি বক্সে কিছু না দিয়ে ফেরত যাওয়ার কোনো গতান্তর নেই।
মাঝে মধ্যে রাস্তার মোড়ে একাধিক বা এক শিশুকে ঘুম পাড়িয়ে পাশে ভিক্ষার বক্স দিয়ে অভিভাবককে অন্যত্র গিয়ে ভিক্ষা করতেও দেখা যায়। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা হলো সামাজিক মূল্যবোধকে নষ্ট করার অন্যতম পন্থা হলো ভিক্ষা করা।
বিজ্ঞাপন
আমাদের দেশে ভিক্ষাবৃত্তি একটি নিরাপদ পেশা, ফলে চক্ষুলজ্জাহীনেরা অন্য জেলায় গিয়ে মনের আনন্দে এমন ঘৃণ্য ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর অনেক উন্নয়নশীল দেশে এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত। ফলে সে সব দেশে ভিক্ষুকদের ধরতে পারলে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়।
আমাদের দেশের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০২০’ এর ২০ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, “যদি কোনো ব্যক্তি ভিক্ষাবৃত্তি বা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রির উদ্দেশ্যে কোনো শিশুর হাত-পা-চক্ষু বা অন্য কোনো অঙ্গ বিনষ্ট করেন বা অন্য কোনোভাবে বিকলাঙ্গ বা বিকৃত করেন, তা হলে উক্ত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।”
অন্যদিকে ‘শিশু আইন ২০১৩’ এর ৭১ ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, “কোনো ব্যক্তি যদি কোনো শিশুকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে নিয়োগ করেন বা কোনো শিশুর দ্বারা ভিক্ষা করান অথবা শিশুর তত্ত্বাবধায়ক বা দেখা শুনার দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি যদি ভিক্ষার উদ্দেশ্যে নিয়োগদানে আশ্রয় দান করেন বা উৎসাহ প্রদান করেন, তা হলে তিনি এ আইনের অধীন অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে। উক্ত অপরাধের জন্য তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বছর কারাদণ্ড অথবা ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।”
বিজ্ঞাপন
তবে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে আমাদের দেশে বিভিন্ন আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ভিক্ষুকের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এতে বিভিন্নভাবে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। কাজেই প্রকৃত ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনপূর্বক এ পেশায় নিয়োজিত অন্যদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করে এমন ঘৃণিত পেশাকে নিরুৎসাহিত তথা বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লেখক : সিএ টু সিইও, জেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম।