পরিবারসহ দেশ ছাড়া বেনজীর, অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা

গত ৪ মে তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দেশ ত্যাগ করনে বেনজীর
বিজ্ঞাপন
পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ গত ৪ মে সপরিবারে দেশ ছেড়েছেন। তবে তিনি কোন দেশে রয়েছে তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াসা। পুলিশের সাবেক আইজিপির অবস্থান নিয়ে তার ঘনিষ্ঠদের অনেকেই বলছেন তিনি সিঙ্গাপুর আছেন, আবার কেউবা বলছেন দুবাইয়ে আছেন তিনি।
বেনজীর আহমেদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে করে গত ৪ মে তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দেশ ত্যাগ করনে বেনজীর।
বিজ্ঞাপন
ঘনিষ্ঠ এ সুত্রটি আরও জানায়, স্ত্রী জীশান মির্জার চিকিৎসাজনিত কারণে সিঙ্গাপুর অবস্থান করছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
অন্য আরেকটি সূত্র বলছে, বেনজীর, তার স্ত্রী জিসান মির্জা, দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাশিন রাইসা বিনতে বেনজীর দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। তবে তারা সেখানে কী উদ্দেশ্যে গেছেন সে বিষয়ে জানাতে পারেনি ওই সূত্র।
বিজ্ঞাপন
এদিকে সম্পদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও তিন মেয়েকে তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মঙ্গলবার (২৮ মে) সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় থেকে তাদের তলবি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। দুদকের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে, আগামী ৬ জুন বেনজীর আহমেদকে এবং ৯ জুন তার স্ত্রী জীশান মির্জাসহ সন্তানদের দুদকের কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়।
বিজ্ঞাপন
বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সম্পদ জব্দের আগেই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে নিয়েছেন কি না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে যথেষ্ঠ সংশয়। দুদকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার (২৩ মে) তাদের অ্যাকাউন্ট জব্দের আদেশ দেন আদালত। তবে এসব অ্যাকাউন্টে কী পরিমাণ অর্থ ছিল, তা জানা যায়নি। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরানোর মতো করে জমি, ফ্ল্যাট বা অন্য কোনো সম্পদ বিক্রি বা স্থানান্তর করেছেন কিনা, সে তথ্যও এখনো পাওয়া যায়নি।
বেনজীরের সম্পদের বিষয়ে যেসব সরকারি সংস্থা খোঁজ রাখছে, তাদের মধ্যে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, গত সপ্তাহে তার অ্যাকাউন্টগুলো ফাঁকা করা হয়েছে। তিনি বলেন, এর আগের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, যখনই কেউ বুঝতে পারেন তাকে পাকড়াঁওয়ের চেষ্টা চলছে, তখনই তিনি ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে ফেলেছেন। অবশ্য টাকা তুললেও নগদে রেখেছেন, নাকি অন্য কারও অ্যাকাউন্টে জমা করেছেন তা বের করাও সম্ভব।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সম্পূর্ণ বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বলেন, বিভিন্ন ডকুমেন্টের ভিত্তিতে কাজ করে ব্যাংক। ফলে সুনির্দিষ্ট আদেশের কপি ছাড়া মৌখিক কোনো তথ্য কিংবা সংবাদমাধ্যমের খবরের ভিত্তিতে কারো অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে বা স্থানান্তর না করতে দেওয়ার সুযোগ নেই। কেননা, আদালত কারো অ্যাকাউন্ট ফ্রিজের আদেশ দিলে পরে সেটা স্থগিতাদেশ দিতে পারেন। এ রকম ক্ষেত্রে কোনো ব্যাংক টাকা তুলতে না দিলে বিপদে পড়বে।
তিনি বলেন, সাধারণভাবে এ ধরনের ব্যক্তির বিভিন্ন পর্যায়ে নিজস্ব কিছু লোক থাকে। ফলে গোপনে জানিয়ে দেওয়া হতে পারে। আবার পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি এবং দুদকের কার্যক্রমের ফলে এমনিতেই টাকা সরিয়ে ফেলতে পারেন তিনি। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে টাকা ক্যাশ করে বিশ্বস্ত কারো কাছে রাখা হয়।
বিজ্ঞাপন
এখন দেখার বিষয় বেনজীর ও তার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন প্রোফাইলের নিয়ম মেনে টাকা তোলা হয়েছে কিনা। আবার টাকা উত্তোলন বা স্থানান্তরের পর ব্যাংকগুলো নিয়ম মেনে সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট (এসটিআর) এবং নগদ লেনদেন রিপোর্ট (সিটিআর) তৈরি করেছে কিনা।
বিজ্ঞাপন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম অর্থ পাচার, মানি লন্ডারিংসহ এ ধরনের অপরাধ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণা করছেন। বুধবার (২৯ মে) তিনি ওই জাতীয় দৈনিককে বলেন, দুর্নীতিবাজরা আগেই অর্থ সরিয়ে ফেলে, এটাই স্বাভাবিক। বিদ্যমান ব্যাংকিং নিয়মে এটি নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন। তবে সরকার এখন মিডিয়ায় দেখাতে চাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, বেনজীর আহমেদ এক দিনে বেনজীর হননি। তাকে পুলিশের আইজি, র্যাবের ডিজি এ সরকারই বানিয়েছে। হঠাৎ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বহির্বিশ্বে দেখানো হচ্ছে, সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কতটা কঠোর।
এদিকে, বেনজীর আহমেদের দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল সিটিজেন টিভির মালিকানার তথ্যও পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালে এ টিভির অনুমোদনের সময় তারা দুইজনই শিক্ষার্থী ছিলেন।
দেশের সম্পদ অনুসন্ধান চলার মধ্যেই পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বিদেশে থাকা সম্পদের অনুসন্ধানেও নেমেছে দুদক। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে তাদের কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, সেসবের খোঁজ-খবরও নেওয়া হচ্ছে। দুদকের তিন সদস্যবিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটির প্রধান হাফিজুল ইসলামের স্বাক্ষরিত চিঠি বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
দুদকের পক্ষ থেকে বিদেশে সম্পদের খোঁজ নিতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) চিঠি দেওয়া হয়েছে। দেশ থেকে অর্থ পাচার ঠেকাতে নীতিমালা প্রণয়ন ও সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে বিএফআইইউ। সংস্থাটি ‘এগমন্ট গ্রুপ’ নামের একটি ফোরামের সদস্য। এই ফোরাম বিশ্বের ১৭০টি দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত, যারা অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নসংক্রান্ত তথ্য নিয়ে কাজ করে। ২০১৩ সালে এগমন্ট গ্রুপের সদস্যপদ পায় বিএফআইইউ।
আরও পড়ুন: স্ত্রী-সন্তানসহ বেনজীরকে দুদকের তলব
এর আগে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মীর্জাসহ তাদের দুই মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুদক। মঙ্গলবার (২৮ মে) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে তলবের এই চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। চিঠিতে আগামী ৬ জুন তাদের দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশ রয়েছে। তাদের দুই মেয়ে হলেন ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর। তবে আরেক মেয়ে জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীর নাবালিকা হওয়ায় তাকে এর আওতামুক্ত রাখা হয়েছে।
এরই মধ্যে আদালতের আদেশে বেনজীর পরিবারের মালিকানাধীন রাজধানীর গুলশানে বিশালাকৃতির বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, গোপালগঞ্জে ৩৪৫ বিঘা ও মাদারীপুরে ২৭৩ বিঘা জমি জব্দ এবং অসংখ্য ব্যাংক ও বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন বেনজীর, তার বেশির ভাগই তিনি কেনেন আইজিপি পদে দায়িত্ব গ্রহণের পর।
এদিকে, দুবাই, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে বেনজীর আহমেদ এবং তার পরিবারের কোনো সম্পদ আছে কিনা, সে তথ্য অনুসন্ধানের অনুরোধ জানিয়ে বিএফআইইউতে একটি চিঠি দিয়েছে দুদক। দুদকের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে এসব দেশের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ। প্রাথমিক অনুসন্ধানে এসব দেশে সম্পদ পাওয়া গেলে পরবর্তী সময়ে সে বিষয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্টের (এমএলএআর) আওতায় তথ্য চেয়ে চিঠি দেবে সরকার।
তিনি আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, চাকরিজীবনের শেষ দুই বছরে অর্থাৎ আইজিপি থাকাকালেই পরিবারের সদস্যদের নামে ৪৬৬ বিঘা জমি কেনেন সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা। ১৯টি প্রতিষ্ঠানে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তার পরিবার হয়ে যায় পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী পরিবার। আর আইজিপি পদটি যেন তার কাছে হয়ে ওঠে ‘আলাদীনের চেরাগ’।
এমএল/