লোহার শিকলের ওপারে দিনগুলো খালেদা জিয়ার কারাবাস

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যাঁর নাম উচ্চারিত হলেই প্রতিবাদের সাহস ও আপসহীন নেতৃত্বের কথা উঠে আসে, তিনি বেগম খালেদা জিয়া। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবন যেমন গৌরবের, তেমনি কারাবাসে ভরা এক সংগ্রামী ইতিহাসও বটে। তার গ্রেপ্তার ও বন্দিজীবনের ঘটনাগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গভীরভাবে ছাপ রেখে গেছে।
বিজ্ঞাপন
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ১৯৮০-এর দশক তিন বার গ্রেপ্তার হন খালেদা জিয়া। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে দেশে সামরিক শাসন জারি করলে বাংলাদেশের রাজনীতি এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়। এই স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল রাজপথে নামলে সদ্য দলের নেতৃত্বে উঠে আসা খালেদা জিয়া দ্রুত আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখে পরিণত হন।
গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে কর্মসূচি পালনের সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই গ্রেপ্তারের পর ৮ দিন কারাগারে থাকার পর তিনি মুক্তি পান। স্বল্প সময়ের এই কারাবাসই তাকে সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
বিজ্ঞাপন
১৯৮৩ সালের পর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন আরও বিস্তৃত ও সংগঠিত হয়। ছাত্র, শ্রমিক ও রাজনৈতিক দলগুলো একযোগে রাজপথে নেমে আসে। এই প্রেক্ষাপটে ৩ মে ১৯৮৪ খালেদা জিয়াকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়।
এই গ্রেপ্তার ছিল মূলত প্রতিরোধমূলক, যাতে তিনি সরাসরি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে না পারেন। তবে সরকারের এই কৌশল আন্দোলনের গতি থামাতে ব্যর্থ হয়। বরং তার অনুপস্থিতিতেই আন্দোলন আরও দৃঢ় ও বিস্তৃত হয়।
১৯৮৭ সাল ছিল এরশাদ সরকারের জন্য সবচেয়ে সংকটপূর্ণ সময়। বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল একযোগে গণআন্দোলনের ডাক দেয়। দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। গণআন্দোলনকে নেতৃত্বহীন করা জন্য আবারও ১১ নভেম্বর ১৯৮৭ ঢাকায় বড় ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচির আগে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বিজ্ঞাপন
এই তিনটি গ্রেপ্তার মূলত গণতান্ত্রিক যুদ্ধ ও তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরোধিতা করার কারণে হয়েছিল।
২০০৬ সালের পরে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সামরিক পৃষ্ঠপোষকতায় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে ক্ষমতায় আসে। ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় খালেদা জিয়াকে। এসময় তিনি দির্ঘ ৩৭২ দিন কারাগারে ছিলেন। ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ জামিনে মুক্তি পান আপোসহীন নেত্রী।
ওয়ান–ইলেভেনের সরকার বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল— জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা।
বিজ্ঞাপন
২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তাঁকে সংসদ ভবনসংলগ্ন বিশেষ কারাগারে রাখা হয়। এই ঘটনাকে বিএনপি ও সমর্থকরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ হিসেবে দেখলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার একে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ বলে ব্যাখ্যা করে। এই সময় দীর্ঘদিন তিনি কারাবন্দি থাকেন এবং রাজনীতি কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে।
২০১৮ সাল ছিল জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তে উত্তাল রাজনৈতিক সময়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত বেগম খালেদা জিয়াকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। বিচারিক প্রক্রিয়া ছিলো তড়িঘড়ি ও পক্ষপাতদুষ্ট। দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ঐ দিন তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। প্রথমে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড কারাগারে বন্দি ছিলেন খালেদা জিয়া। পরে স্বাস্থ্যগত কারণে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে রাখা হয়। প্রায় দীর্ঘ ২ বছরেরও বেশি সময় তিনি কার্যত কারাগারে ছিলেন। ২৫ মার্চ ২০২০-এ সরকার শর্তসাপেক্ষে তাকে মুক্তি দেয় (কারাগারের সাজা স্থগিত করে বাসায় চিকিৎসার অনুমতি দেয়)। তবে এটিও পুরোপুরি মুক্তি নয়, আইনি শর্তে গৃহবন্দিত্বের মতো অবস্থা ছিল। ২০২৪ সালের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত তাকে রাজনৈতিকভাবে বন্দি অবস্থায় রাখা হয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
পরবর্তীতে জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাহী আদেশে খালেদার দণ্ড মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেন। ২০২৪ সালের ২৭ নভেম্বর খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলা থেকে খালাস পান।
তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী আপষহীন নেত্রী, যিনি গণতন্ত্রের জন্য সারাজীবন যুদ্ধ করে গেছেন। অনেকের কাছে গণতন্ত্রের মা, বাংলাদেশের মা বেগম খালেদা জিয়া। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।








