ব্যাংক সেক্টেরের মাফিয়া পূবালী ব্যাংক এমডি

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে ডলার কারসাজি, নিয়োগবাণিজ্য ও ঋণ জালিয়াতিসহ নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউয়ে তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অনুসন্ধান চলছে। অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ আলী ও তার সমন্বিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগ অনুসারে, মোহাম্মদ আলী দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকের এমডি পদে থেকে নিয়োগ বাণিজ্য, ঋণ বিতরণে দুর্নীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার কারসাজি চালিয়ে আসছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্তেও তার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ডলার কারসাজির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই দুর্নীতি ও অনিয়ম ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, মোহাম্মদ আলী ও ব্যাংকের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে, যা নিয়োগ বাণিজ্য, ডলার কারসাজি, সম্পত্তি বিক্রি, ঋণ বিতরণে অনিয়মসহ নানা দুর্নীতিতে জড়িত। বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় এবং বাণিজ্যের আড়ালে রহস্যজনক অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত ইতিপূর্বে ক্ষমতার দাপটে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পূবালী ব্যাংকের এই চক্রের অন্যতম হোতা ছিলেন প্রয়াত এইচটি ইমামের আত্মীয় সিরাজগঞ্জের মোহাম্মদ আলী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটির এমডি ও সিইও পদে রয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সাইদুর রহমান ও এস কে সুরের সহযোগিতায় এই চক্র ব্যাংকটিকে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করে।
বিজ্ঞাপন
এছাড়া, পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমানের যাবতীয় দুর্নীতি ও অপকর্মের সহযোগী মোহাম্মদ আলী। তাকে হাত করে বোর্ড সভাকে পাশ কাটিয়ে মঞ্জুরুর রহমান ও তার ছেলে জেহাদ রহমানসহ সংশ্লিষ্টরা নানা দুর্নীতি করে যাচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে অর্থপাচার, অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির পৃথক চারটি অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে, পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলীকে পুনরায় নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, যা ব্যাংকের অংশীদার ও পরিচালকদের মধ্যে চরম অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে। তাদের দাবি, এই নিয়োগ ব্যাংকের শুদ্ধাচার ও স্বচ্ছতার প্রতি চরম অবমাননা।
এদিকে, দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জনৈক ফরহাদ হোসেন দুদকে একটি অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগে পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুরুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ আলী, সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজ আহমেদ মজুমদার, তৎকালীন পরিচালক ফাহিম আহমেদ ফারুক এবং অন্য পরিচালক কবিরুজ্জামান ইয়াকুবের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।
দুদক অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে এবং ঢাকা-১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. হাফিজুর রহমানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
বিজ্ঞাপন
এছাড়া, পূবালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদারের বিরুদ্ধেও অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালে অনিয়মের দায়ে ১০ পরিচালককে সরানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। হাফিজ আহমেদ মজুমদার বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া পরিচালক ফাহিম আহমেদ ফারুক চৌধুরী ও এম খাবিরুজ্জামান ইয়াকুবসহ কয়েকজন এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা বলে দুদকের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
অপরদিকে পূবালী ব্যাংক থেকে বিতর্কিত ব্যবসায়ী সাদ মুসা গ্রুপকে শতকোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এম এ রহমান ডাইং পূবালী ব্যাংকের সিডিএ এভিনিউ শাখা থেকে ঋণ নেয়। প্রথম দিকে নিয়মিত ঋণ থাকলেও পরে অনিয়মিত ঋণে পরিণত হয়। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি পাওনার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭১ কোটি ৭৮ লাখ ২৫ লাখ ১৯৬ টাকা। বর্তমানে এই টাকার পরিমান চারশত কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়াও সাদ মুসা গ্রুপ পূবালী ব্যাংক থেকে এলসি সুবিধাসহ বিভিন্নভাবে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। দুদকের একজন উপপরিচালকের নেতৃত্বে পৃথক একটি দল এই আত্মসাতের অভিযোগ তদন্ত করছে।
ইতোমধ্যে দুদকের টিম ব্যাংকটির এমডি মোহাম্মদ আলী ও চেয়ারম্যান মনজরুর রহমানসহ সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাদের জন্য তলবী নোটিশ দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সাদ মুসা গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় এমডি চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক। পূবালী ব্যাংকের ফরিদপুর অঞ্চলের একজন অংশীদারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী ফরিদপুর ভিত্তিক করিম গ্রুপকে প্রায় ১৮৪৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। যার পুরোটাই খেলাপী। এই ঋণ বিতরণে মোহাম্মদ আলী ও একজন পরিচালক ৫শতাংশ হারে ঘুষ নিয়েছেন বলে দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
এবিষয়ে কমিশন একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। করিম গ্রুপকে দেওয়া ঋণের মধ্যে ফান্ডেড ফ্যাসিলিটি ৬০৯ কোটি, নন ফান্টেড ফ্যাসিলিটি ১২৩৪ কোটি টাকা। বর্তমানে ফোর্স লোন ১১০ কোটি টাকা সহ ব্যাংকের পাওনা ৫৮৬ কোটি ও সর্বমোট প্রায় ৯০০ কোটি টাকা যা আদৌ আদায়যোগ্য নয় বলে বলা হয়েছে।
এ বিষয় পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলীর মুঠো ফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি। এমকি ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে উত্তর মেলেনি।