ডিপিডিসি’র এমডি নিয়োগে বিপু বলয়

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)-এর নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সম্প্রতি প্রকৌশলী বি. এম. মিজানুল হাসানকে তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক এমডি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, যা এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে যোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে। এই ঘটনা দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন প্রকৌশলীরা। তারা এই ঘটনা তদন্তের দাবি জানান।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগ সূত্র বলছে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স-১ শাখা গত ২২ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপন (স্মারক নং: ২৭.০০.০০০০.০৮৮.১১.০০৫.২৪৪৭৩) জারি করে। তাতে বলা হয়, ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ডিপিডিসির ৩৮৭তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ডিপিডিসির অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, বোর্ড সভার কার্যবিবরণীতে এমন কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। অর্থাৎ মন্ত্রণালয় যে বোর্ড সিদ্ধান্তের কথা প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছে, সেটি নথিগতভাবে বিদ্যমান নয়। বিষয়টি প্রশাসনিক সত্য গোপনের অভিযোগ তুলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এমডি পদের জন্য লিখিত, মৌখিক ও সক্ষমতা মূল্যায়নে তিনজন প্রার্থী ছিলেন ১. প্রকৌশলী সাব্বির আহমেদ, ২. মো. শরিফুল ইসলাম, ৩. প্রকৌশলী বি. এম. মিজানুল হাসান। মূল্যায়নে প্রথম হন সাব্বির আহমেদ, তবে তাঁর বিদেশি অভিজ্ঞতা সনদে ছিলো গরমিল, কানাডায় যে কোম্পনী দেখিয়েছে সেই কোম্পনীর অস্থিত্ব নেই। “বিদ্যুৎ বিতরণ খাতসংক্রান্ত নয়” বলে নিয়োগ বোর্ড তা গ্রহণ করেনি।
বিজ্ঞাপন
দ্বিতীয় স্থানে থাকা প্রার্থীকে উপেক্ষা করে তৃতীয় স্থানে থাকা মিজানুল হাসানকে নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়নি বলে জানান এক বোর্ড সদস্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বোর্ড সদস্য বলেন, প্রজ্ঞাপনে ৩৮৭ তম বোড সভার যে সিদ্ধান্তে কথা বলা হয়েছে তা সঠিক নয়। কারণ বোর্ড সভায় তৃতীয় স্থানে থাকা প্রকৌশলী মিজানুল হাসানকে একক ভাবে সুপারিশ করা হয়নি। এক সঙ্গে তিনজন প্রার্থীকে সুপারিশ করা হয়।
ফলে প্রকৌশলীদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন যোগ্যতায় তৃতীয় হয়েও কীভাবে তিনি শীর্ষ পদে নিয়োগ পেলেন? একাধিক প্রকৌশলী ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ দাখিল কওে বিস্তারিত তুলে ধরেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সমান সুযোগের নীতি লঙ্ঘনের শামিল। প্রশাসনিক আইনের মূলনীতি অনুযায়ী, সেরা প্রার্থীকে বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে লিখিত যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে হয় যা এখানে নেই। তাঁদের মতে, এটি শুধু স্বচ্ছতার অভাব নয়, বরং প্রশাসনিক ন্যায্যতার অবমাননা।
বিজ্ঞাপন
‘বিপু বলয়’ সক্রিয়: বিদ্যুৎ বিভাগে প্রভাব বিস্তারকারী এক সময়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ঘনিষ্ঠ প্রশাসনিক বলয় এখনো সক্রিয় এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ডিপিডিসির তিনজন উচ্চপদস্থ পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং, অপারেশন, ও ফাইন্যান্স) পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) থেকে এসেছেন এবং বিপু-র সময়কার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
নতুন এমডি মিজানুল হাসানও একই বলয়ের অংশ বলে অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তারা দাবি করছেন। তাঁদের মতে, “এই নিয়োগ কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং ‘বিপু বলয়’-এর পুনরুত্থানের ইঙ্গিত।” বিদ্যুৎ বিভাগ এর আগে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেশন কমিটি(বিইআরসি) সদস্য নিয়োগেও বিতর্কে জড়িয়েছিল। সেখানে গিয়াস উদ্দিন জোয়ারদার নামের একজনকে চুক্তিভিত্তিকভাবে নিয়োগের পর জনসমালোচনার মুখে একদিনের মধ্যেই সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়।
কিন্তু এবার, লিখিত পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েও ডিপিডিসির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে তিন বছরের চুক্তি দেওয়া বিদ্যুৎ বিভাগের স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলছেন সাবেক এক নির্বাহী পরিচালক। ২০২৪ সালের “মেধা না কোটা” আন্দোলনে তরুণেরা যে মূল্যবোধের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন, যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ ও সমান সুযোগ, সেই নীতিই এই ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ।
বিজ্ঞাপন
একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “যেখানে পরীক্ষায় তৃতীয় প্রার্থী এমডি হন, সেখানে আর মেধার মূল্য কীভাবে থাকবে?”
মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অর্জনকারী প্রার্থীকে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হলেও বিতর্কের সূত্রপাত অন্য জায়গায়। তিনি শুধু তৃতীয় অবস্থানেই ছিলেন তা নয়, বিদ্যুৎ বিতরণ খাতে তাঁর কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতাও নেই। ফলে প্রকৌশলী মহলের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন যোগ্যতায় পিছিয়ে থাকা এবং বিতরণ ব্যবস্থায় অভিজ্ঞতাহীন একজন কর্মকর্তা কীভাবে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার শীর্ষপদে নির্বাচিত হলেন?
বিজ্ঞাপন
এ বিষয়ে ইতোমধ্যে একাধিক প্রকৌশলী দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন; যেখানে নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও ন্যায়সংগত মূল্যায়ন নিয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করে যথাযথ তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির দৈনিক জনবাণীকে বলেন, আমরা সত্য মিথ্যা সকল অভিযোগ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিই।








