Logo

বন্ধু বেনজীরের যোগ্যতায় ডিপিডিসির এমডি মিজানুল

profile picture
বশির হোসেন খান
২৩ অক্টোবর, ২০২৫, ১১:১৬
25Shares
বন্ধু বেনজীরের যোগ্যতায় ডিপিডিসির এমডি মিজানুল
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া।

ঢাকা, ৫ আগস্ট গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রশাসন ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পরিচালিত করার প্রত্যাশা ছিল ব্যাপক। তবে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)-এর নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী বি এম মিজানুল হাসানের নিয়োগ সেই প্রত্যাশায় বড় ধরনের প্রশ্নচিহ্ন সৃষ্টি করেছে।

বিজ্ঞাপন

গত বুধবার বিদ্যুৎ বিভাগের কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স-১ শাখার উপসচিব ফারজানা খানম স্বাক্ষরিত পত্রে জানা গেছে, পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের (পিজিসিবি) প্রধান প্রকৌশলী মিজানুল হাসান তিন বছরের চুক্তিভিত্তিক এমডি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুজন প্রার্থী ছিল। প্রকৌশলী বি এম মিজানুল হাসান ও আরেকজন ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম। গত ২৬ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ ভবনে লিখিত, প্রেজেন্টেশন ও মৌখিক পরীক্ষায় মিজানুল হাসান তৃতীয় স্থান অর্জন করলেও তিনিই এমডি পদে নির্বাচিত হন। সেই সময় এক প্রার্থীর যোগ্যতা নিয়ে তিনটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক জনবাণী। এরপরই নিয়োগ কমিটি নড়েচড়ে বসে।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, পরীক্ষায় পরাজিত হলেও তিনি কেন গুরুত্বপূর্ণ পদে বাছাই হলেন। সূত্র বলছে, সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের গভীর ঘনিষ্ঠতার কারণে এবং আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধু পরিষদের সঙ্গে নিবিড় রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকার সুবাদে মিজানুল হাসানের নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শৈশব এবং কৈশোর থেকে বেনজীর আহমেদের সঙ্গে একসাথে বেড়ে ওঠা মিজানুল হাসান তার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচিতি হিসেবে আওয়ামী দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। কর্মস্থলে মিজানুল হাসান প্রায়শই বেনজীর আহমেদের প্রভাব এবং সুপারিশ কাজে লাগাতেন, যা তার পেশাগত অবস্থানকে সুদৃঢ় করে তুলেছিল।

এ সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও দক্ষতার প্রশ্ন তুলে ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেক প্রকৌশলী। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান দুই প্রার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। যদিও নিয়োগ কমিটি প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর সক্রিয় হয়েছিল, তারপরও যোগ্যতার প্রশ্নে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ পদ্ধতির স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার ওপর নতুন করে সংশয় সৃষ্টি করেছে। কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতার পরিবর্তে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কতটা ভূমিকা রাখে এ প্রশ্ন এখন প্রকৌশলীদের। একাধিক প্রশাসনিক আইনজীবী জানিয়েছেন, এটি চ্যালেঞ্জযোগ্য একাধিক এই নিয়োগ আইনি দিক থেকেও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। যদি প্রমাণ করা যায় যে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল উপেক্ষা করে কোনো প্রভাবশালী সূত্রের মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন, তাহলে তা প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল বা হাইকোট জি রিটযোগ্য (প্রবন্ধ ১০২) বিষয়।

বিজ্ঞাপন

সিনিয়র অ্যাডভোকেট বেলায়েত হোসেন বলেন, যদি যোগ্যতার মানদণ্ড ও পদ্ধতি লঙ্ঘন হয়, তাহলে নিয়োগপত্রের বৈধতা আদালত স্থগিত রাখতে পারেন। এটি প্রক্রিয়াগত অন্যায় এর একটি ক্লাসিক উদাহরণ। তৃতীয় হয়েও প্রথম প্রশ্ন মেধা ও ন্যায্যতা নিয়ে পাওয়ার ডিভিশনের সাম্প্রতিক প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, এমডি পদে আবেদনকারীদের মধ্যে নির্বাচিত প্রার্থী ছিলেন পরীক্ষায় তৃতীয় স্থানে। লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষাতেই তাঁর অবস্থান প্রথম দুই প্রার্থীর পর। তবুও, চূড়ান্ত নিয়োগে তাঁর নামই উঠে আসে যেন ফলাফল আগেই নির্ধারিত ছিল। আরও বিতর্কের বিষয়, এই প্রার্থীর বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থাপনা বা ডিস্ট্রিবিউশন সেক্টরে কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। অথচ তাঁর চেয়ে বেশি যোগ্য ও অভিজ্ঞ দুজন প্রার্থী বাদ পড়েন কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই। ডিপিডিসির অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, বোর্ড মিটিংয়েও এই নিয়োগ নিয়ে মতভেদ ছিল। একাধিক পরিচালক নিয়োগের ন্যায্যতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আপত্তি তুললেও, সিদ্ধান্ত আসে “উর্ধ্বতন নির্দেশে”।

আইনে বলা আছে, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) ২০০৮, বিধি ১২৭ (১) মেধা ও যোগ্যতার মান নির্বাচন নিয়ন্ত্রণমূলক; এই কমিটি সেই একই গঠন লঙ্ঘন করেছে। কোম্পানি আইন ১৯৪, ধারা ১৮৫-১৮ বোর্ডের সিদ্ধান্ত যদি নীতি অনৈতিক প্রভাব বা পার্টির নীতি হয়, তা বাতিলযোগ্য।

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, এমডি পদে প্রার্থীদের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় স্থানে। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী তাঁর অবস্থান ছিল দুইজনের পরেই। তবুও, চূড়ান্ত নিয়োগে তাঁর নামই উঠে এল যেন পূর্বনির্ধারিত কোনো স্ক্রিপ্ট অনুসারে। আরও বিস্ময়ের বিষয়, তাঁর ডিস্ট্রিবিউশন বা বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। তবু তাঁকেই “যোগ্যতম” হিসেবে বিবেচনা করা হলো। প্রশ্নটা তাই এখন স্রেফ একটি ব্যক্তিকে ঘিরে নয়; প্রশ্নটা পুরো প্রক্রিয়াটাকে ঘিরে যোগ্যতার চেয়ে যোগসূত্র কি আবারও জয়ী হলো?

বিজ্ঞাপন

অভিযোগ বলছে, গত ১৭ বছর ধরে গোপালগঞ্জ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক শক্তির এক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে সেই প্রভাব ছিল দৃশ্যমান পদায়ন, পদোন্নতি, এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার অনুমোদন পর্যন্ত। ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর অনেকে ভেবেছিলেন, সেই একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান ঘটবে। কিন্তু ডিপিডিসির এই নিয়োগ যেন দেখিয়ে দিল, সেই ছায়া এখনো পুরোপুরি সরে যায়নি। ক্ষমতার চেইন হয়তো কিছুটা নড়েছে, কিন্তু শেকড় এখনো অটুট। যেন এক নিঃশব্দ বার্তা গোপালগঞ্জ এখনো শক্তিশালী, শুধু মুখ বদলেছে। ৫ আগস্টের আন্দোলন ছিল ন্যায়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রতীক। সেই আন্দোলনের দাবি ছিল “যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ চাই, স্বজনপ্রীতি নয়।” কিন্তু ডিপিডিসির এই সিদ্ধান্ত সেই মূল্যবোধের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। গতকাল এই নিয়োগ শুধু একটি প্রশাসনিক পদায়ন নয়; এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা যে বার্তা বলে, পরিবর্তনের ঘোষণার পরও পুরনো ক্ষমতার রেশ এখনো জীবিত।

সূত্র বলছে, যদি কোনো প্রার্থী পরীক্ষায় পিছিয়ে থেকেও অপ্রকাশিত প্রভাবের মাধ্যমে পদ পান, তবে তা কেবল নৈতিক নয় আইনি দিক থেকেও প্রশ্নবিদ্ধ। সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা ও মেধাভিত্তিক মূল্যায়নই মূলনীতি। সেই নীতি উপেক্ষিত হলে নিয়োগটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অবৈধতার ছায়া পায়। এই ঘটনাটি তাই কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের নয়, এটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক সংস্কৃতির আয়না। ৫ আগস্টের পর মানুষ বিশ্বাস করতে চেয়েছিল “নতুন বাংলাদেশ” মানে নতুন চিন্তা, নতুন নীতি, নতুন মানুষ। কিন্তু ডিপিডিসির নিয়োগ যেন বলছে, পুরনো খেলাটা চলছে, শুধু খেলোয়াড় বদলেছে।

এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির দৈনিক জনবাণীকে বলেন, আমি সবসময়ই বস্তুনিষ্ঠ অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই।

বিজ্ঞাপন

জেবি/আরএক্স
Logo

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ

মোঃ শফিকুল ইসলাম ( শফিক )

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ৫৭, ময়মনসিংহ লেন, ২০ লিংক রোড, বাংলামটর, ঢাকা-১০০০।

ফোনঃ 02-44615293

ই-মেইলঃ dailyjanobaninews@gmail.com; dailyjanobaniad@gmail.com

জনবাণী এর সকল স্বত্ব সংরক্ষিত। কপিরাইট © ২০২৫

Developed by: AB Infotech LTD

বন্ধু বেনজীরের যোগ্যতায় ডিপিডিসির এমডি মিজানুল