Logo

সারাদেশে ডেঙ্গুর অন্ধকার ছায়া

profile picture
বিশেষ প্রতিবেদক
২২ অক্টোবর, ২০২৫, ১৭:২৪
7Shares
সারাদেশে ডেঙ্গুর অন্ধকার ছায়া
প্রতীকী ছবি।

বাংলাদেশ, একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ যেখানে মৌসুমী বর্ষা এবং উষ্ণ আবহাওয়া মশাবাহিত রোগের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে, বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বর একটি ভয়াবহ মহামারীর মুখোমুখি।

বিজ্ঞাপন

এ বছরের এই পর্যন্ত রোগটি একটি জাতীয় সংকটের রূপ নিয়েছে, যা না শুধু স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চাপের মুখে ফেলেছে, বরং অর্থনীতি, সমাজ এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে বিপর্যস্ত করেছে। ডেঙ্গু, যা এডিস মশা দ্বারা ছড়ায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর মৌসুমী রোগ হিসেবে দেখা দেয়, কিন্তু এবছরের পরিস্থিতি অভূতপূর্ব।

আরও পড়ুন: ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা আড়াইশ ছাড়াল

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালের শুরু থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৬০,০০০ জন আক্রান্ত হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এই রোগের ভয়াল রূপ এমন যে, এটি শুধু শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়, গ্রামীণ এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে, এবং মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

বিজ্ঞাপন

ডেঙ্গুর এই মহামারীটি কেবল একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তন, শহুরে অস্তিত্বহীনতা, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা এবং জনসচেতনতার অভাবের ফল। বিগত বছরগুলোতে, বিশেষ করে ২০২৩ সালে, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল, যখন ১,৭০৫ জন মারা যায় এবং ৩২১,০০০ এরও বেশি আক্রান্ত হয়। কিন্তু ২০২৫ সালে এটি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে, কারণ ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপের উপস্থিতি এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন এটিকে আরও মারাত্মক করে তুলেছে।

বর্তমান পরিস্থিতি

২০২৫ সালের অক্টোবর ২১ তারিখ পর্যন্ত, বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৬০,০০০ এ পৌঁছেছে, এবং মৃত্যুর সংখ্যা ২৪৫ এরও বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দৈনিক রিপোর্ট অনুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় (অক্টোবর ২০ তারিখ) ৯৪২ জন নতুন আক্রান্ত হয়েছে এবং ৪ জন মারা গেছে। এটি একটি উদ্বেগজনক ট্রেন্ড, কারণ সেপ্টেম্বর মাসে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল, এবং অক্টোবরেও এটি অব্যাহত রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ এতটাই বেশি যে, অনেক হাসপাতালে বিছানা সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে দেশজুড়ে ২,০৪৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছেন, যার মধ্যে ঢাকায় ৭৪৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ১,৩০০ জন। ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ রূপটি কেবল সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়। রোগটি এখন ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬৩টিতে ছড়িয়ে পড়েছে, যা একটি জাতীয় মহামারীর চিত্র তুলে ধরে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবছরের আক্রান্তের হার গত বছরের তুলনায় ৮১% বেশি। এটি শুধু শহুরে এলাকায় নয়, গ্রামীণ অঞ্চলে যেমন বরিশাল, খুলনা এবং চট্টগ্রামেও সমানভাবে ছড়াচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দীর্ঘায়িত বর্ষা এবং উষ্ণতা এডিস মশার প্রজননকে ত্বরান্বিত করেছে, যা এই মহামারীর মূল কারণ।

এছাড়া, শহুরে অভিবাসন, অপর্যাপ্ত নিকাশি ব্যবস্থা এবং জলাশয়ের অভাব এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো-উচ্চ জ্বর, মাথাব্যথা, পেশীব্যথা, বমি এবং রক্তপাত প্রথমে সাধারণ ফ্লু-এর মতো মনে হয়, কিন্তু গুরুতর ক্ষেত্রে এটি ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বা শক সিন্ড্রোমে পরিণত হয়, যা মারাত্মক।

বিজ্ঞাপন

শিশু এবং বয়স্করা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালে আক্রান্তদের মধ্যে ০-৫ বছরের শিশুরা ৩,৬৪৩ জন, এবং ৬-১০ বছরের ৩,২৭১ জন। এটি একটি সামাজিক সংকটও, কারণ অনেক পরিবার অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে চিকিৎসার খরচে।

কতটা ভয়াল রূপ নিয়েছে?

বিজ্ঞাপন

ডেঙ্গুর এই মহামারীটি কতটা ভয়াবহ তা বোঝার জন্য গত বছরগুলোর সাথে তুলনা করা যাক। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সবচেয়ে খারাপ বছর ছিল, যখন ৩২১,০০০ আক্রান্ত এবং ১,৭০৫ মৃত্যু ঘটে। কিন্তু ২০২৫ সালে, অক্টোবর পর্যন্ত কেস সংখ্যা ৫০,৬৮৯ এবং মৃত্যু ২১৫ এ পৌঁছেছে, এবং বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন যে এটি ২,৮২,০০০ থেকে ৭,৯১,০০০ কেস এবং ১,২৪০ থেকে ৪৫৮ মৃত্যুতে পৌঁছাতে পারে। এটি একটি দ্রুত বর্ধমান ট্রেন্ড, কারণ সেপ্টেম্বরে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল, এবং অক্টোবরেও এটি অব্যাহত।

ভয়াবহতার আরেকটি দিক হলো রোগের সেরোটাইপের বৈচিত্র্য। বাংলাদেশে চারটি ডেঙ্গু ভাইরাস সেরোটাইপ (ডিইএনভি-১ থেকে ৪) উপস্থিত, যা পুনরায় সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায় এবং মারাত্মকতা বৃদ্ধি করে। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দীর্ঘায়িত মৌসুম এবং উচ্চ আর্দ্রতা মশার প্রজননকে সহায়তা করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল (ইসিডিসি) এর রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রবণতা বাড়ছে, এবং এটি আন্তর্জাতিক স্তরে উদ্বেগের কারণ।

অর্থনৈতিক প্রভাবও ভয়াবহ। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের চিকিৎসা খরচ, কাজের অক্ষমতা এবং কৃষি ক্ষয়ক্ষতি দেশের জিডিপিকে প্রভাবিত করছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২৩ সালের মহামারীতে অর্থনৈতিক ক্ষতি কয়েকশো কোটি টাকা ছিল, এবং এবছর এটি আরও বেশি হতে পারে। এছাড়া, রোগটি শিশুমৃত্যুর হার বাড়াচ্ছে, যা দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে ঝুঁকিতে ফেলছে।

বিজ্ঞাপন

ডেঙ্গুর পরিস্থিতি অঞ্চলভিত্তিকভাবে ভিন্ন, কিন্তু ঢাকা সবচেয়ে আক্রান্ত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্যাশবোর্ড অনুসারে, ঢাকা ডিভিশনে সবচেয়ে বেশি কেস, যেখানে ঢাকা সিটিতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২০,০০০ এরও বেশি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় মৃত্যুর সংখ্যা ৮৩, যা দেশের সর্বোচ্চ, এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এ ১৯ জন মারা গেছে।

এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত, প্রায় ১০,০০০ কেস এবং ৫০ এর বেশি মৃত্যু। এখানে গত ২৪ ঘণ্টায় অনেক নতুন কেস।

চট্টগ্রাম বিভাগে আক্রান্ত প্রায় ৮,০০০, মৃত্যু ৪০ এর বেশি। এখানে শহুরে এবং বন্দর এলাকায় ছড়ানো। খুলনা বিভাগে কেস ৫ হাজার মৃত্যু ৩০ এর বেশি। বর্ষার কারণে জলাবদ্ধতা সমস্যা। রাজশাহী বিভাগে কেস ৪ হাজার মৃত্যু ২৫ এর বেশি। রংপুর বিভাগে কেস ৩ হাজারের বেশি মৃত্যু ২০ ছাড়িয়েছে। সিলেট বিভাগে কেস ২ হাজার ৫শ’ ছাড়িয়েছে মৃত্যু ১৫ এর বেশি। ময়মনসিংহ বিভাগে কেস ২ হাজার ছাড়িয়েছে মৃত্যু ১০ এর বেশি।

বিজ্ঞাপন

এই তথ্যগুলো দেখায় যে, ডেঙ্গু এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, এবং ঢাকা এর কেন্দ্রবিন্দু। গত সপ্তাহে ঢাকায় ৭৫৫ নতুন কেস এবং ১ মৃত্যু।

বিশ্লেষকদের সতর্কতা

বিজ্ঞাপন

বিশ্লেষক এবং বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গুর এই মহামারীকে জলবায়ু-চালিত সংকট হিসেবে দেখছেন। রয়টার্সের রিপোর্ট অনুসারে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, এবং জরুরি পদক্ষেপ দরকার। একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের পর থেকে কেস ১.৯ গুণ বেড়েছে।

এনটমোলজিস্ট ড. কবিরুল বাশার বলেন, “এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ না হলে এটি আরও খারাপ হবে। জনসচেতনতা এবং মশক নিধন অভিযান জোরদার করতে হবে।” মেশিন লার্নিং-ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আবহাওয়া ভেরিয়েবল যেমন তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাত ডেঙ্গু প্রেডিকশনে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে, সরকারের উদাসীনতা এটিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর সম্প্রতি বলেন, চলতি বছর ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সি রোগীদের মধ্যে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। এবছর কেসও বেশি, কিন্তু আমরা সার্ভেইল্যান্স বাড়িয়েছি।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম জানিয়েছেন, ডেঙ্গু ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আমাদের সব জায়গায় হাসপাতালগুলোকে অ্যালার্ট (সতর্ক) করে দেয়া আছে যাতে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমানো যায়। আমরা চেষ্টা করছি সকলকে সচেতন করতে। বিভিন্ন জায়গায় সবার সঙ্গে কথা বলছি যাতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আমরা জরুরি সমন্বয় করছি, কিন্তু জলবায়ু-চালিত এই সংকটে জনভাগীদারিতা দরকার।

জেবি/এসডি
Logo

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ

মোঃ শফিকুল ইসলাম ( শফিক )

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ৫৭, ময়মনসিংহ লেন, ২০ লিংক রোড, বাংলামটর, ঢাকা-১০০০।

ফোনঃ 02-44615293

ই-মেইলঃ dailyjanobaninews@gmail.com; dailyjanobaniad@gmail.com

জনবাণী এর সকল স্বত্ব সংরক্ষিত। কপিরাইট © ২০২৫

Developed by: AB Infotech LTD