পূবালী ব্যাংকের এমডি দুধে ধোয়া তুলশি পাতা

পূবালী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ আলীকে ধোয়া তুলশি পাতা আখ্যা দিলেন নিয়োগ কর্তা মঞ্জুরুর রহমান। দুর্নীতিবাজ খ্যাত মোহাম্মদ আলীকে পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে পুনঃনিয়োগ চুড়ান্ত করা হয়েছে। ৭ জন পরিচালকের বোর্ডে আপত্তি উপেক্ষা করে একক সিদ্ধান্তে এই নিয়োগ চুড়ান্ত করেন ব্যংকের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান।
বিজ্ঞাপন
এমডির বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে মাসিক ২৭ লাখ টাকা। অন্য সব তফসিলভুক্ত ব্যংকের চেয়েও অনেক বেশি। বিষয়টি ঘিরে ব্যাংকের অভ্যন্তরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা দেখা দিয়েছে। এতে খোদ পরিচালক ও ব্যাংকটির অংশীদারগন চরম আপত্তি তুলেছেন।
তারা বলেন, পূবালী ব্যাংকে ১৪৮৯ তম বোর্ড সভায় ১২ জন পরিচালকের মধ্যে ৭ জন পরিচালকের অনুপস্থিতি ও অসম্মতির পরও দুর্নীতিবাজ এমডি মোহাম্মদ আলীকে পুনরায় নিয়োগ অনেকটা চুড়ান্তর পথে। ওই সভায় মাত্র ৩জন পরিচালক উপস্থিত ছিলেন। এনিয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। মোহাম্মদ আলী ও মঞ্জুরুর রহমানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দুদকে দুর্নীতি সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
এছাড়া ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মঞ্জুর রহমানের বিরুদ্ধে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দেড় হাজার কোটি দুর্নীতির অভিযোগ সুনির্দিষ্ট ভাবে প্রমানিত। যা বিচারাধীন আছে এবং সে কারণেই দুর্নীতিবাজ এমডিকে দিয়ে অর্থ আত্মসাতের সুবিধার্থে কথিত এমডিকে পুনর্নিয়োগে মরিয়া হয়ে উঠেছেন মঞ্জুরুর রহমান।
পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, পূবালী ব্যাংকে চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমানের যাবতীয় দুর্নীতি ও অপকর্মের সহযোগী মোহাম্মদ আলী। তাকে হাত করে বোর্ড সভাকে পাশ কাটিয়ে মঞ্জুরুর রহমান ও তার ছেলে জেহাদ রহমানসহ সংশ্লিষ্টরা নানা দুর্নীতি করে যাচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে অর্থপাচার, অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির পৃথক চারটি অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। এরপরও ২৭ লাখ টাকা বেতনে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও মোহাম্মদ আলীকে পুন:রায় নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
অধিকাংশ পরিচালকের আপত্তি উপেক্ষা করে পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান তার দুর্নীতির সারথী মোহাম্মদ আলীকে পুন:রায় নিয়োগ দেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি শাখার প্রধান ও ডেপুটি গভর্নর কবির হোসেন তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করছেন। পূবালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচ লেনদেনেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোহাম্মদ আলী পুন:রায় নিয়োগ পেলে ব্যাংকটিতে মন্দ ঋণ ও খেলাপী ঋণের পরিমান বাড়বে। ইতোমধ্যে মোহাম্মদ আলী ও মঞ্জুরুর রহমানের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগে তদন্ত অব্যাহত রেখেছে দুদক। এছাড়াও মোহাম্মদ আলী ও মঞ্জুরুর রহমানের জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়েও শিগগিরই তদন্ত শুরু হবে বলে জানা গেছ। দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জনৈক ফরহাদ হোসেন দুদকে একটি অভিযোগ দাখিল করেন।
আরও পড়ুন: হাসিনার আশির্বাদে মতিনের দাপট
অভিযোগে পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুরুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ আলী, সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজ আহমেদ মজুমদার, তৎকালীন পরিচালক ফাহিম আহমেদ ফারুক এবং অন্য পরিচালক কবিরুজ্জামান ইয়াকুবের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। দুদক অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে এবং ঢাকা-১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. হাফিজুর রহমানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি অভিযোগ সশ্লিষ্টদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
বিজ্ঞাপন
দুদক থেকে পাওয়া অথ্য অনুযায়ী মোহাম্মদ আলী ও মঞ্জুরুর রহমানের নেতৃত্বে পূবালী ব্যাংকে একটি শক্তিশালী চক্র ব্যাপক অনিয়ম, নিয়োগ বাণিজ্য, ডলার কারসাজি, সম্পত্তি বিক্রি, ঋণ বিতরণে অনিয়মসহ নানা দুর্নীতিতে জড়িত। বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় এবং বাণিজ্যের আড়ালে রহস্যজনক অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত ইতিপূর্বে ক্ষমতার দাপটে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
পূবালী ব্যাংকের এই চক্রের অন্যতম হোতা ছিলেন প্রয়াত এইচটি ইমামের আত্মীয় সিরাজগঞ্জের মোহাম্মদ আলী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটির এমডি ও সিইও পদে রয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সাইদুর রহমান ও এস কে সুরের সহযোগিতায় এই চক্র ব্যাংকটিকে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করে। ২০২৩ সালে এই চক্র ডলার কারসাজির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে।
বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ডলার কিনে ২১১ কোটি টাকা বেশি ব্যয় বা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, মঞ্জুরুর রহমান ও মোহাম্মদ আলী চক্র হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসীদের এক্সচেঞ্জ করা শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেলে না দিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন বলে দুদকের তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিজ্ঞাপন
দুদক সূত্র আরও জানায়, ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ২৫ লাখ গ্রাহকের আমানতের ১ হাজার ১৪১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পূবালী ব্যাংকের অন্যতম অংশীদার ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারধারী হিসেবে মঞ্জুরুর রহমান পরিচালক ছিলেন।
তিনি ডেল্টা লাইফে তার চার সন্তানকে পরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছেন এবং কন্যা আদিবা রহমানকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদে বসিয়েছেন। ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে তিনি পূবালী ব্যাংকেও লুটপাট অব্যাহত রেখেছেন। ডেল্টা লাইফের ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা আত্মসাতের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ডাটাবেজ সার্ভারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুছে ফেলার অভিযোগও রয়েছে মঞ্জুরুর রহমানের বিরুদ্ধে।
এছাড়া, পূবালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদারের বিরুদ্ধেও অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালে অনিয়মের দায়ে ১০ পরিচালককে সরানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। হাফিজ আহমেদ মজুমদার বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া পরিচালক ফাহিম আহমেদ ফারুক চৌধুরী ও এম খাবিরুজ্জামান ইয়াকুবসহ কয়েকজন এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা বলে দুদকের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগে আরও বলা হয়, সাবেক এমপি হাফিজ আহমেদ মজুমদার বর্তমানে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান। তার আগে চেয়ারম্যান ছিলেন মঞ্জুরুর রহমান। তারা দুজনই প্রায় দেড় যুগ ধরে পূবালী ব্যাংক ও ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যানের পদ দখল করে লুটপাট ও অর্থ আত্মসাৎ করছেন। তাকে দুদক দুই দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
এ ব্যাপারে পূবালী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ আলী মুঠো ফোনে কল দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এমকি ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে উত্তর মেলেনি। পূবালী ব্যংকের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান বলে, মোহাম্মদ আলী ধোয়া তুলশি পাতা বললে দোষ হবে না। কারণ সে তিন হজ্ব করেছেন। তা ছাড়া সে পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। তার সঙ্গে আমার পাবিারিক সম্পর্ক।
বিজ্ঞাপন
এক প্রশ্নের জবাবে উত্তেজিত হয়ে বলেন, মোহাম্মদ আলী দুর্নীতিবাজ নয়, যে যদি কোনো অনিয়ম করতেন তাহলে আমাকে বলতেন। বলা যায় যে আমার খুব কাছের। একক সিদ্ধান্তে নিয়োগ দিতে পারেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, যে যেহেতু ভালো মানুষ তাহলে দিলে দোষ কি? অভিযোগ রয়েছে আপনার সঙ্গে তার অর্থনৈতিক লেনদেন রয়েছে এমন প্রশ্ন করলে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, আমি তোকে মামলা দিয়ে জেলে খাটাবো। তুই কত বড় সাংবাদিক তা আমি দেখবো। তুই আমাকে চিনিস না। আমার হাত কত বড় লম্বা। দুদক আমার বিরুদ্ধে লেগেছে, কিছু করতে পারেনি। দুদক আমার সম্পর্কে যেনে গেছে।