‘টিকিটি সিন্ডিকেটের’ টাকায় স্ত্রীসন্তানসহ লন্ডন ভ্রমণে উপসচিব

মধ্যপ্রাচ্যের টিকিট সিন্ডিকেটের টাকায় স্ত্রীসন্তান নিয়ে বিলাসবহুল লন্ডন সফরে গিয়েছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মুতাকাব্বির আহমেদ এমন চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের একাধিক সূত্রে। এই ঘটনার জেরে তাকে এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) এর প্রশাসক পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বিজ্ঞাপন
গত বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন-২ শাখা থেকে জারি করা আদেশে বলা হয়, “আটাবের বৃহত্তর স্বার্থে উপসচিব মুতাকাব্বির আহমেদ-কে প্রশাসকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।” একই আদেশে নতুন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ড. সাইফ উদ্দিন আহম্মদ, যুগ্মসচিব, ট্রেড সাপোর্ট মেজারর্স উইং, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-১ শাখার প্রজ্ঞাপন (নং২৬.০০.০০০০.০০০.০৮৬.৩১.০৭৯২.২৫.২৩৪, তারিখ ১৯ আগস্ট ২০২৫) অনুযায়ী, উপসচিব মুতাকাব্বির আহমেদ ২১ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে ছুটিতে ছিলেন।
বিজ্ঞাপন
প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ রয়েছে, মুতাকাব্বির আহমেদ (পরিচয়পত্র নং ১৬০৪৭, পাসপোর্ট নং ঊ০০১৫৪৯৮২), তার স্ত্রী আফরোজ ফারজানা তুলি (পাসপোর্ট নং অ০৬৬৪৮৮৯১), এবং দুই কন্যা, মাহজাবীন আহমেদ আফরা (পাসপোর্ট নং অ০৬৬৩৬৭৫০) এবং মাহভীন আহমেদ আকসা (পাসপোর্ট নং অ০৬৮৬৫৮৭৬) তিনি লন্ডন সফরে যান।
যদিও নথিতে বলা হয়েছে, ভ্রমণের সব ব্যয় তিনি নিজে বহন করবেন তবে প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ একাধিক সূত্র জানায়, ওই টাকার মূল অংশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের টিকিট সিন্ডিকেটের কাছ থেকে ‘সুবিধা’ হিসেবে নিয়েছেন। প্রতি টিকিটের মূল্য ছিল ২ লাখ ৭৮ হাজার ৪০৬ টাকা, যা চারজনের জন্য মোট দাঁড়ায় ১১ লাখ ১৩ হাজার ৬২৪ টাকা। এই অর্থের উৎস নিয়েই এখন উঠছে প্রশ্ন। সূত্র বলছে, ২১ আগস্ট সকাল ৮:৫৫ মিনিটে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে লন্ডনে যাত্রা। ৩১ আগস্ট লন্ডন থেকে বেলজিয়ামে পৌঁছান এবং সেখানে একদিন অবস্থান করেন। এরপর ২ সেপ্টেম্বর বেলজিয়াম থেকে প্যারিসে যান, যেখানে দুই দিন অবস্থান করেন।
৪ সেপ্টেম্বর প্যারিস থেকে আবার লন্ডনে ফেরেন এবং ৬ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরেছেন। এটি তার দ্বিতীয় বড় ইউরোপ সফর। চলতি বছরের ৫ জুলাই তিনি নেদারল্যান্ডস সফর করেন। আর্মস্টারডামে মাদাম তুশো যাদুঘর এবং হেগে আন্তর্জাতিক আদালতসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখেন। ৭ জুলাই নেদারল্যান্ডস থেকে বেলজিয়ামে ফেরেন। ১১ জুলাই বেলজিয়ামে একটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের পর ১২ জুলাই বেলজিয়াম থেকে ফ্রান্সের প্যারিসে বুলেট ট্রেনে যাত্রা করেন।
বিজ্ঞাপন
প্যারিসে বাংলাদেশের বিমান টিকিট সিন্ডিকেটের একটি বড় অংশের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন এবং লুভর মিউজিয়াম, আইফেল টাওয়ার ও ফ্রান্সের সংসদ ভবনসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখেন। তার পূর্ববর্তী ইউরোপ সফর ১৮ জুলাই শেষ হয়। ২০ দিনের সফরের পর টার্কিশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে ফ্রান্স থেকে ঢাকা ফেরেন। সফরের যাবতীয় খরচ বহন করেছে টিকিট সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্য, যা সাধারণ জনগণের মধ্যে বিতর্কের বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে।
ফের বেপরোয়া টিকিট সিন্ডিকেট: মুতাকাব্বির আহমেদকে গত ৪ আগস্ট ২০২৫ তারিখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আটাবের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই মধ্যপ্রাচ্যের রুটে বিশেষ করে সৌদি আরব, দুবাই, কুয়েত ও ওমানগামী ফ্লাইটের টিকিটের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়। ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর অভিযোগ, প্রশাসকের পদে থেকে মুতাকাব্বির আহমেদ একটি নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটকে বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দিয়েছেন। ফলে সাধারণ যাত্রীদের টিকিট কিনতে হয়েছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি দামে।
আটাবের সাবেক এক সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “সরকারের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যদি নিজেই সিন্ডিকেটের টাকায় বিদেশে বিলাস ভ্রমণ করেন, তাহলে সাধারণ মানুষ কার কাছে ন্যায়বিচার চাইবে?” তিনি আরও বলেন, “এই ঘটনাটি প্রমাণ করেছে, প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতিই বিমান টিকিটের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির মূল কারণ।”
বিজ্ঞাপন
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (অঃদাঃ) মুহাম্মদ রেহান উদ্দিন স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়েছে, নতুন প্রশাসক ড. সাইফ উদ্দিন আহম্মদ আগামী চার মাসের মধ্যে সুষ্ঠু ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও আটাবের নির্বাচন সম্পন্ন করবেন। অন্যদিকে, মুতাকাব্বির আহমেদের বিদেশ সফর ও টিকিট ক্রয়ের আর্থিক উৎস নিয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
সাধারণ যাত্রী নাসির উদ্দিন বলেন, টিকিট সিন্ডিকেটের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া হাজারো প্রবাসী শ্রমিকের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। এক শ্রমিক বলেন, “আমরা ঘাম ঝরিয়ে দেশে টাকা পাঠাই, আর কিছু অফিসার সেই টাকায় লন্ডনে ঘুরে বেড়ায়— এটা লজ্জাজনক।”
বিজ্ঞাপন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আটাবের সিনিয়র সদস্য বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের টিকিট সিন্ডিকেটে জড়িত থেকে পরিবারসহ লন্ডনে বিলাসবহুল ভ্রমণ— এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে এটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক ইতিহাসে অন্যতম বড় কেলেঙ্কারি হিসেবে বিবেচিত হবে। এখন দেখার বিষয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কতটা কঠোর অবস্থান নেয়। এ ব্যাপারে অভিযুক্ত আটাবের সাবেক প্রশাসক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মুতাকাব্বির আহমেদ মুঠো ফোনে একাধিকবার কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি।








