ডিপিডিসি’র মাফিয়া প্রকৌশলী ফয়েজ করিম

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা চাষাড়া-মহাসড়ক সংলগ্ন ৬ একর ৭৫ শতাংশ জমিতে আশা সমবায় সমিতি লিমিটেডের আবাসিক বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করতে ডিপিডিসির ‘বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্প’-এ নকশাগত ত্রুটি, অতিরিক্ত খুঁটি স্থাপন, ব্যয় নির্ধারণে অস্বচ্ছতা এবং প্রশাসনিক তদারকির ঘাটতির মতো একাধিক অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পে জড়িত কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগও তুলেছেন সংশ্লিষ্ট গ্রাহক ও স্থানীয়রা।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগ অনুযায়ী, গ্রাহকের আবেদন অনুযায়ী মাত্র ৪টি খুঁটি স্থাপনের জন্য ডিপোজিট জমা নেওয়া হলেও বাস্তবে প্রকল্প এলাকায় ৪৫টি খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে, যার ৪১টির জন্য কোনো ডিপোজিট নেওয়া হয়নি। এতে সরকারের ৫ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রকল্পের একজন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মী বলেন, তারা চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সিএনডিসি এর অধীনে কাজ করছেন এবং ডিপিডিসির নির্বাহী প্রকৌশলীর নির্দেশ অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ডিপিডিসির এই অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণে করে ডিপিডিসি’র পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন সিষ্টেম ডেভেলপমেন্ট, প্রজেষ্ট আন্ডার প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আমিন ও নির্বাহী প্রকৌশলী মোহম্মদ ফয়েজ করিম বৈদ্যুতিক খুঁটি নিমাণের নামে ২ কোটি টাকা হরিলুট করেছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেন। এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি অভিযোগ জমা পেড়েছে।
সিএনডিসি দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকতা দীনেশ শীল বলেন, আমরা চীনা ঠিকাদার কোম্পানির লোক। আমরা ডিপিডিসি’র কেউ নয়। প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়েজ করিম স্যার যে ভাবে বলেন, আমরা সেই ভাবে কাজ করি।
বিজ্ঞাপন
নাম প্রকাশে আনিচ্ছুক প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, ফয়েজ করিম স্যার মানেই অনিয়ম। তিনি টাকা ছাড়া কিছু বুঝেন না। টাকা পেলেই তিনি সব করতে পারেন। সিএনডিসি’র চীনা ঠিকাদার কোম্পানিকে ব্যবহার করে শত শত কোটি টাকা মালিক বনে গেছেন।
এ ব্যাপারে কুতুবপুর এলাকার বাসিন্দা মনিরুল হক বলেন, প্রকৌশলী ফয়েজ করিম একজন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ। তিনি আমার ছোট একটি বিদ্যুতের কাজ করে দিয়ে ৩০ লাখ টাকা নিয়েছেন। যা ডিপিডিসির ব্যাংক একাউন্ট এ জমা হয়নি। ফয়েজ করিবের রাজধারীর বেইলি রোডে তার বাসায় নগদ পৌছে দেওয়া হয়।
সূত্র বলছে, প্রকল্পে অসঙ্গতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পটি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নকশায় অস্বচ্ছতা, মাঠপর্যায়ের বাস্তবায়ন, ব্যয় নির্ধারণ, গ্রাহকের ওপর অতিরিক্ত চাপ সব মিলিয়ে প্রকল্পটি এখন দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। ডিপিডিসির বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পের জব নং: ডিপিডিসি/ডিপি(এস)/১০০৮২০২৫-৫১৫ডি ডিপোজিটের টাকা জমা দেওয়া হয়। গ্রাহকের আবেদনের পর ডিপিডিসির সংশ্লিষ্ট দপ্তর সরেজমিনে পরিদর্শন করে নতুন এইচটি-এলটি লাইন নির্মাণ ও ট্রান্সফরমার স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে নকশা প্রণয়নে ছিল গুরুতর অস্বচ্ছতা।
বিজ্ঞাপন
আশা সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইছমত উল্লাহ গণমাধ্যমে জানান, ডিপিডিসি কর্তৃক সরবরাহ করা প্রাথমিক নকশা অনুযায়ী কাজ করলে সমবায় এলাকার প্রতিটি প্লটে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ, নকশা প্রণয়নের ভিত্তিই ছিল অসম্পূর্ণ ও অপ্রতুল। স্থায়ী রাস্তা ছাড়া বালুভর্তি জমিতে খুঁটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী বিদ্যুৎ খুঁটি স্থাপনের আগে ভূমির স্থায়িত্ব, রাস্তার উচ্চতা, এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়ন বিবেচনায় নকশা করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু মাঠ পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। প্রকল্প এলাকায় এখনও স্থায়ী রাস্তা নির্মিত হয়নি, পুরো জমি এখনো বালু ভরাট অবস্থায় রয়েছে। বালুর ওপর বিদ্যুৎ খুঁটি স্থাপন ঝুঁকিপূর্ণ বলে পরিদর্শন টিম উল্লেখ করেছে।
নিরাপত্তা বা নীতিমালা না মেনে কেন প্রকল্প জব প্রস্তুত হলো এবং দ্রুত কাজ শুরু হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে দুই কোটি টাকা ঘুষ লেনদেনের পরেই তড়িঘড়ি প্রকল্পের নকশা প্রনয়ণ করেন নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়েজ করিম ও প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আমিন। তবে সেই নকশা অস্বচ্ছতা রয়ে গেছে। স্থানীয় গ্রাহকদের দাবি, এমন সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা বা খুঁটি ধসে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
এদিকে উচ্চ ব্যয়ের প্রাক্কলন এবং স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে প্রকল্পে। চার পুল নির্মাণ খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ৬৯ লক্ষ ৪৮ হাজার ৬৬৩ টাকা। এসপিসি পুল, এসিএসআর ডিওজি, ডব্লিউএএসপি ক্যাবল, ট্রান্সফরমার চারটি খুঁটির সঙ্গে এই খরচ ধরা হয়েছে। সুপারভিশন চার্জ ২০% এটির যৌক্তিকতা কোথাও ব্যাখ্যা উল্লেখ নেই, সার্ভিস চার্জ ২.৫% কোনো নীতিমালার ভিত্তিতে এটি আরোপ করা হয়েছে তা অস্পষ্ট।
বিজ্ঞাপন
এ বিষয়ে সমবায় সদস্য ও এলকাবাসীর অভিযোগ একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রাক্কলন এত অস্পষ্ট হওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যয় নির্ধারণের স্বচ্ছতা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয়, গ্রাহকরা যখন জবের বিপরীতে পুরো অর্থ পরিশোধ করলেন, তখন দেখা গেল ডিপিডিসির নকশায় ভুল রয়েছে। নকশা অনুযায়ী বৈদ্যুতিক খুঁটি বসালে কিছু প্লটে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া যাবে না। এরপরই প্রতিষ্ঠানটি পুনরায় আবেদন করে অতিরিক্ত খুঁটি স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। অর্থাৎ, প্রাথমিক নকশা যথাযথ না হওয়ায় গ্রাহককেই গুনতে হবে অতিরিক্ত অর্থ। স্থানীয় এক গ্রাহক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ডিপিডিসির ভুলে আমাদের খরচ বাড়বে কেন? প্রথম নকশাই যদি সঠিক হতো, তাহলে অতিরিক্ত খরচ প্রয়োজনই পড়ত না। সূত্র বলছে, প্রশাসনিক ব্যর্থতা না ইচ্ছাকৃত অব্যবস্থাপনা। প্রকল্পের বিভিন্ন ধাপে একাধিক অসঙ্গতি স্পষ্ট রয়েছে। নকশা অনুমোদনের আগে পর্যাপ্ত পর্যালোচনা হয়নি। মাটির অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও খুঁটি স্থাপনের প্রস্তুতি ব্যয় নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে বলে জানা গেছে।
সারোজমিন দিয়ে নথি যাছাই-বাছাই করেই প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহম্মদ ফয়েজ করিমের ব্যক্তি দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত এমন প্রমাণ মিলেছে।
এই বিষয় ডিপিডিসির নারায়নগঞ্জ(পূর্ব) নির্বাহী প্রকৌশলী নাঈম হাসান মাহমুদ বলেন, আমাকে অবগত না করেই প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়েজ করিম বৈদ্যুতিক খুঁটি নির্মান করছেন। বিষয়টি প্রকল্প পরিচালকসহ কতৃপক্ষে অবহিত করেছি। এ ছাড়া তো আমার কিছু করার নেই। নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়েজ করিম কখনোই প্রকল্পের কাজ করলে আমাকে আবহিত করেন না। তা মত করে করেন। হয়তো অফিস অবহিত আছেন। তবে নিয়ম মেনে করলে আমাকে অবহিত করা উচিত। না করলে তো আমার কিছু করা নেই।
বিজ্ঞাপন
তিনি আরো বলেন, আমি আপনার কাছ থেকে শোনার পর ফয়েজ করিমকে ফোন করি তার পরে আমাকে একটা কাগজ পাঠান। সেই কাগজের সূত্র ধরেই যদি বলি, তাহলে এই প্রকল্পের কাজে গড়মিল রয়েছে। ঘটনাটি জানার পর আমি কাজ বন্ধ করেছি। কিন্তু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়েজ করিম আমাকে অবহিত না করে কাজ চালিয়ে যান। সেই ক্ষেত্রে তো আমার কিছু করা নেই। আমি কতৃপক্ষকে জানাতে পারবো।
এ ব্যাপারে প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহম্মদ ফয়েজ করিম স্বীকার করে বলেন, পাঁচটি বৈদ্যুতিক খুঁটি বেশি বসানো হয়েছে এটা সত্য। তবে আমি নিয়ম মানার চেষ্টা করি। নিয়মের মধ্য থাকি। তিনি এক পর্যায় হুমকি দিয়ে বলেন, আমি নিয়ম মানবো কি মানবো না সেটা আমার বিষয়। আমি যা করি প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আমিনের সঙ্গে আলোচনা করেই করি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ফয়েজ করিমের সঙ্গে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) মোরশেদ আলম খানের সু-সম্পর্ক। ফয়েজ করিম আমার দফতরে এসে দম্ভ করে বলেন, আমাকে কেউ কিছু করতে পারবে না। আমার সঙ্গে নির্বাহী পরিচালক স্যারের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। প্রায় তিনি আমার বাসায় আসেন। আমার সঙ্গে তার সব সময় ওঠা-বসা। তাই চাইলে আমার কেউ ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখেন না। এ ছাড়া মহামান্য রাষ্ট্রপতি শাহবুদ্দিন চুপ্পু আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। কেউ আমার বিরুদ্ধে মুখ খুললেই তার চাকরি হারাতে হবে। আর যদি কোনো সাংবাদিক আমার বিরুদ্ধে লাগে তা জীবন হারাতে হবে। তাই আমি ডিপিডিসির এমডি কিংবা নির্বাহী পরিচালকের ধারধারি না। আমার ক্ষতি করার ক্ষমতা ডিপিডিসির কেউ রাখে না।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি এ ধরনের প্রকল্প সাধারণ মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। তারা বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগের মতো সেবা দিতে গিয়ে যদি অনিয়ম বা অব্যবস্থাপনা হয়, তাহলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষই হয়রানির শিকার হবে। স্থানীয়রা মনে করেন, ডিপিডিসির উচ্চপর্যায়ের তদারকি আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। না হলে প্রকল্প বাস্তবায়নে এ ধরনের অসামঞ্জস্য ভবিষ্যতেও ঘটতে পারে।
আশা সমবায় সমিতি ইতোমধ্যে চিঠি দিয়ে বলেছে সমস্ত নকশাগত ভুল সংশোধন করে প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হোক, না হলে সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ ছাড়া অনেক গ্রাহক চাইছেন নকশা প্রণয়ন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, খুঁটি বাড়ানোর প্রয়োজন কেন হলো তার তদন্ত, ব্যয় নির্ধারণের যৌক্তিকতা যাচাই, প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দায়িত্বশীল পক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি তোলা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ ধরনের অসঙ্গতি কি অব্যবস্থাপনা, নাকি সুশাসনের ঘাটতি? সরকারি সংস্থার এমন প্রকল্পে স্বচ্ছতা বজায় না থাকলে ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ সেবায় আস্থা হ্রাস পেতে পারে, এমনই আশঙ্কা রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
এ ব্যাপারে প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আমিন বলেন, আপনি ফজের করিমের বিরুদ্ধে এমডি ও জ্বালানী উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। তারা বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখবে। এ বিষয় কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই।
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে যেসব আইন, বিধি এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেসব বিধিমালা রয়েছে তা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই। ব্যতিক্রম হচ্ছে চুনোপুঁটির বেলায় এসব আইন প্রয়োগের দু-একটি ঘটনা। তবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে প্রভাবশালী চক্রের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয় না।
তিনি বলেন, আইন যথাযথ ও দৃষ্টান্তমূলকভাবে প্রয়োগ করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তথাকথিত বিভাগীয় পদক্ষেপ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যকর ভূমিকা নিলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। প্রিয় পাঠক, আগামী পর্বে থাকছে পিডিএসডি প্রকল্পের হরিলুটের মাস্টার প্রকৌশলী ফয়েজ করিম








