ডেসকোর প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ারের মূল্য ৫ কোটি টাকা

ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)-তে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী গোলাম রব্বানীকে প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি দিতে বোর্ড চেয়ারম্যানকে ৫ কোটি টাকা ঘুষ লেনেদেনে নজিরবিহীন অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে সংস্থার অভ্যন্তরে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয় প্রকৌশলীরা দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি অভিযোগ জমা দিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
কর্মকর্তারা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে এতে প্রশাসনিক বিপর্যয় ও কর্মকাণ্ডে অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে। প্রকৌশলীদের অভিযোগ, গোলাম রাব্বানির ডেসকোতে যোগদান থেকে শুরু করে প্রতিটি পদোন্নতিই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বর্তমানে তিনি প্রধান প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন যেটি তিনি বেশ কয়েকজন সিনিয়র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে ডিঙিয়ে পেয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, বোর্ড চেয়ারম্যান মুহাম্মদ রফিকুল ইসলামের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ব্যবহার করেই তিনি এ সুবিধা নিয়েছেন। কয়েকজন প্রকৌশলী দুদকে অভিযোগ করেছেন বোর্ড চেয়ারম্যান ৫ কোটি টাকার বিনিময়ে এই পদোন্নতি দিচ্ছেন। কারণ নতুন চেয়ারম্যান ড. মো. সানোয়ার জাহান ভূঁইয়ার কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের আগে বিদায়ী চেয়ারম্যানই নাকি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি করে তাকে পদোন্নতি দিতে উদ্যোগ নেন।
নথিপত্র অনুযায়ী, গোলাম রাব্বানি ২০০৩ সালে ডেসকোতে যোগ দেন। তার নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। কিন্তু গোলাম রাব্বানি তা ১০ কোটি টাকায় ‘ম্যানেজ’ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০০৭ সালে তিনি অন্তত ১৫ জন সিনিয়র কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে পদোন্নতি পান। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরও তার ‘সুদিন’ অব্যাহত থাকে।
বিজ্ঞাপন
এমনকি সার্ভিস রুল উপেক্ষা করে, পদ না থাকলেও দায়িত্ব পালন করেন যা ডেসকোর ইতিহাসে আগে দেখা যায়নি বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর গোলাম রাব্বানি আরও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেন। নিজেকে বঞ্চিত কর্মকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করে তিন মাসের মধ্যে নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি বাগিয়ে নেন।
কর্মকর্তাদের দাবি, ৫ আগস্টের পর ডেসকোতে পদোন্নতি পাওয়া একমাত্র ব্যক্তি তিনি। পদোন্নতি পেয়েই তিনি সিনিয়র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কামরুজ্জামানকে সরিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অভিযোগ রয়েছে বোর্ড চেয়ারম্যান ও নির্বাহী পরিচালক (এইচআর)-এর সহযোগিতায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে তিনি ২০১৮ সাল থেকে সিনিয়রিটি গ্রহণ করেন, যা সম্প্রতি অনুমোদিতও হয়েছে। এদিকে গোলাম রাব্বানির বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে দুদক তদন্ত শুরু করেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুদক অভিযোগ পায় যে তিনি যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ডেসকোতে আবেদন ও নিয়োগ লাভ করেন এবং এভাবে অবৈধভাবে ৮ কোটি টাকা সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
অভিযোগ সূত্র বলছে, তিনি ২০০০ সালে পল্লীবিদ্যুৎ সমিতিতে যোগ দেন। ডেসকোর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর তার অভিজ্ঞতা ছিল ২ বছর ৬ মাস, যেখানে প্রয়োজন ছিল ৫/৮ বছরের। যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও প্রভাব খাটিয়ে ২০০৩ সালের ৪ মে ডেসকোতে যোগদান করেন। এরপর সিনিয়রদের ডিঙিয়ে দ্রুত পদোন্নতি পেতে থাকেন।
বিজ্ঞাপন
তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও তাকে বরখাস্ত করা হয়নি; শুধু ভবিষ্যতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিবেচনায় না আনার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ৫ আগস্টের পর আবারও তিনি বঞ্চিত কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে দ্রুত পদোন্নতি লাভ করেন এবং প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব নেন। অভিযোগ রয়েছে, ডেসকোতে যোগদানের পর তিনি অবৈধ অর্থ অর্জন করে উত্তরায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন এবং প্রধান প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা নিচ্ছেন। ২২ মে দুদক তার নিয়োগসংক্রান্ত সব নথি, জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর, পাসপোর্ট নম্বর, টিন নম্বর, স্ত্রী-সন্তানের তথ্যসহ ব্যক্তিগত রেকর্ডের সত্যায়িত কপি চেয়ে ডেসকোকে চিঠি দেয়। তবে বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে তিনি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
৫ নভেম্বর ৫১৭তম বোর্ড সভায় তার পদোন্নতির বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। ১২ নভেম্বর ৫১৮তম সভায় তা অনুমোদিত হয়। ২৫ নভেম্বর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ১৩ নভেম্বর ডেসকোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের পর নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া। এর পরপরই বিদায়ী চেয়ারম্যান মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালক এইচআরকে ডেকে এক বছরের মধ্যে পুনরায় পদোন্নতির নির্দেশ দেন। এহেন ‘তুঘলকি কাণ্ডে’ ডেসকোর পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রকৌশলী বলছে, বিদায়ী চেয়ারম্যান রফিকুল স্যার যাওয়ার আগে চেটে খেয়ে যাবে। টাকার বিনিময়ে গোলাম রব্বানীকে পদোন্নতি দিচ্ছেন। টাকা ছাড়া কিছু বুঝেন না চেয়ারম্যান। দুদক বিষয়টি তদন্ত করলে আসলে ঘটনা বের হয়ে আসবে।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগ প্রসঙ্গে গোলাম রাব্বানি বলেন, পদোন্নতি পরীক্ষার বিষয়ে কোনো চিঠি পাননি। তিনি জানান, চলতি বছরে দুর্নীতি দমন কমিশন তাঁর সম্পর্কে কোনো তথ্য চেয়েছে কি না এ বিষয়েও তিনি অবগত নন। ৫ আগস্টের পর নিজেকে বঞ্চিত কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে তিনবার পদোন্নতি নেওয়ার অভিযোগ উঠলে তিনি বলেন, আমার সক্ষমতা ও যোগ্যতা আছে বলেই আমি তিন দফা পদোন্নতি নিতে পেরেছি। টাকা দিয়ে পদোন্নতি নিয়েছেন এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সে বিষয় আমার জানা নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, রব্বানীকে প্রধান প্রকৌশলী পদ চুড়ান্ত করার আগে ডেসকো বোর্ড চেয়াম্যানের যাছাই-বাছাই করার দরকার ছিলো। না যেনে যদি পদোন্নতি দেয়। সেটা ঠিক হবে না। ভুল হবে। কারণ গোলাম রব্বানীর বিষয় তদন্ত করছে। ইতোমধ্যে ডেসকোর চেয়ারম্যানকে চিঠি রব্বানীসহ তার পরিবারের সকল সদস্যর বিষয় তথ্য চাওয়া হয়েছে।
গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ডেসকোর বোর্ড চেয়ারম্যান মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম প্রথমে মিটিংয়ে থাকার কারণ দেখিয়ে বক্তব্য দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। পরে অনুরোধে সাড়া দিয়ে তিনি সংক্ষেপে বলেন, ৫ কোটি টাকার ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, “আমি কারও কাছ থেকে কোনো টাকা নেইনি। যদি কেউ এমন অভিযোগ করে থাকে, সেটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।” দুদকের চলমান তদন্তের মধ্যে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া যায় কি না এমন প্রশ্নে রফিকুল ইসলাম জানান, গোলাম রব্বানীর পদোন্নতি প্রসঙ্গে তিনি অবগত নন। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা অর্থ লেনদেনের অভিযোগ সত্য নয়।
বিজ্ঞাপন








