হারিয়ে যেতে বসেছে নরসুন্দরদের গ্রামবাংলার গল্প

ভোরের আলো ফুটতেই এক সময় গ্রামবাংলার হাট-বাজারে দেখা যেত পরিচিত দৃশ্য। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, তাতে কাঁচি, ক্ষুর আর আয়না। পিঁড়িতে বসে আয়নার সামনে মুখ তুলে বসে থাকা মানুষ, নিপুণ হাতে চুল-দাড়ি ছাঁটছেন নরসুন্দর। সেই দৃশ্য আজ শুধু স্মৃতি।
বিজ্ঞাপন
চুয়াডাঙ্গার গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী নরসুন্দর বা নাপিত পেশা ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে। আধুনিক শহুরে জীবনযাত্রা, প্রযুক্তি নির্ভর সৌন্দর্যচর্চা এবং এসি-নন এসি সেলুনের দাপটে গ্রামে গ্রামে পিঁড়িতে বসে চুল কাটার সংস্কৃতি আজ অল্প ক’জন বয়োজ্যেষ্ঠ নরসুন্দরের হাতে সীমাবদ্ধ।
একসময় নরসুন্দররা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে কাজ করতেন। অনেক সময় চুল-দাড়ি কাটার বিনিময়ে ধান নিতেন। কারও কাছে তারা শুধু নাপিত নন, ছিলেন পরিবারের আপনজন। বিয়ে, অন্নপ্রাশন বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। কিন্তু আজকাল মানুষ প্রকাশ্য হাটে চুল কাটতে আর চাইছে না।
বিজ্ঞাপন
জীবননগর উপজেলার ধোপাখালী ও উথলী হাটে দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ নরসুন্দর এখনও এই পেশা আঁকড়ে ধরেছেন। তাদের চোখে ক্লান্তি, কণ্ঠে হতাশা। বর্তমানে চুল ও দাড়ি কাটার জন্য ১৫–২০ টাকা নেওয়া হলেও আগের মতো কাজ নেই। দিন শেষে আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
মনোরুদ্দিন প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলেন,শুরুতে ৩ টাকায় চুল, ২ টাকায় দাড়ি কাটতাম। তখন আয় ভালোই হতো। এখন সব কিছুর দাম বেড়েছে, কিন্তু আমাদের আয় বাড়েনি।
আজও তিনি বাজারের ব্যাগে যন্ত্রপাতি ভরে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়ালেও, বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে পারছেন না।
বিজ্ঞাপন
রবিউল আলম নামের আরেক নরসুন্দর জানান, গ্রামে কাজ করতে গিয়ে মানুষের সঙ্গে তৈরি হওয়া সম্পর্ক আর গল্পগুলোই বেঁচে থাকার শক্তি দেয়। কিন্তু আধুনিক সেলুনের প্রযুক্তি এবং অর্থাভাবে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে অনেক নরসুন্দর এই পেশা ছেড়ে যাচ্ছেন।
নরসুন্দরদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পড়ছে গ্রামবাংলার নিম্ন আয়ের মানুষরা। অল্প টাকায় চুল-দাড়ি কাটার সুযোগ কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে তাদের যেতে হচ্ছে শহরের ব্যয়বহুল সেলুনে।
বিজ্ঞাপন
এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছে গ্রামবাংলার সংস্কৃতি, সম্পর্ক এবং মানবিকতা। কিন্তু নীরবে হারিয়ে যেতে বসা এই নরসুন্দরদের কষ্টের কথা শুনে খুব কম মানুষ ভাবেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সরকারি উদ্যোগ, প্রশিক্ষণ ও সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা প্রয়োজন, নইলে একদিন গ্রামবাংলার পিঁড়ি আর কাঁচি শুধু স্মৃতির পাতাতেই থাকবে।








