বিশ্বনেতাদের মধ্যমণি ড. ইউনূস


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ১২:৩৬ অপরাহ্ন, ২৬শে সেপ্টেম্বর ২০২৪


বিশ্বনেতাদের মধ্যমণি ড. ইউনূস
ছবি: জনবাণী

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে কি-নোট স্পিকার হিসেবে ড. ইউনূস তার বক্তৃতায় বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিবকে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় দ্রুত কনফারেন্স আয়োজন করতে হবে, যা সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সৃজনশীল ও কার্যকরী পন্থা নির্ধারণ করবে বলে মনে করেন তিনি। এ সময় ড. ইউনূস রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তা রক্ষায় অংশীজনদের সঙ্গে কাজ করার বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে সংকটের উত্তরণের আভাস দেন।


জাতিসংঘের সদর দপ্তরে হওয়া এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, মিয়ানমার বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত জুলি বিশপ, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ফিলিপ্পো গ্রান্ডি এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তারা।

বৈঠকের শুরুতে ড. ইউনূস বলেন, জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের ‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান’কে আরও বেগবান করতে হবে এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গণহত্যার মতো অপরাধের বিচার ও জবাবদিহিতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন চাইতে হবে। বিশ্ব নেতাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে এবং প্রতিবছর ৩২ হাজার নতুন শিশু জন্ম নিচ্ছে। সম্প্রতি আরও ২০ হাজার নতুন শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।


রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত চাপ তৈরি করছে, যা নিরাপত্তা ঝুঁকিরও জন্ম দিচ্ছে দাবি করে তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘের বিভিন্ন মহল মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু সংকটের মূল সমস্যার সমাধান না হওয়ায় তা কার্যকর হয়নি বলে অভিযোগ করেন।


রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন করে ২০ কোটি ডলার সহায়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র

বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা এবং তাদের আশ্রয়দানকারী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন করে প্রায় ২০ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

গত মঙ্গলবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া নতুন আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেন। ওয়াশিংটন থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। সহায়তার মধ্যে ১২ কোটি ৯০ লাখ ডলার দেবে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) আর ৭ কোটি ডলার দেবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। এ নিয়ে ২০১৭ সালের পর থেকে আঞ্চলিকভাবে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার পরিমাণ দাঁড়াল ২৫০ কোটি ডলারের বেশি। এর মধ্যে বাংলাদেশে দেওয়া হয়েছে ২১০ কোটি ডলারের বেশি।


ভোটার তালিকা প্রস্তুত হলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা

দেশের সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে ভোটার তালিকা প্রস্তুত হয়ে গেলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

গত মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনের ফাঁকে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সঙ্গে বৈঠকে এ কথা জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে। বর্তমান বাংলাদেশ একটি নতুন দেশ। নতুন সরকার গঠনের পর নির্বাচন, বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতিবিরোধী এবং সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের সুপারিশ করার জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে।

কমিশনের সুপারিশ নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, সংস্কারের বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করা হলে এবং ভোটার তালিকা তৈরি হলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। আইএমএফের প্রধান নির্বাহী ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা এই উদ্যোগে ড. ইউনূসের প্রতি সমর্থন জানান। ঋণদাতা সংস্থা এই সরকারের জন্য আর্থিক সহায়তার বিষয়টি দ্রুত ‘ট্র্যাক করবে’ জানিয়ে জর্জিয়েভা বলেন, তিনি বাংলাদেশে আইএমএফের একটি দল পাঠিয়েছেন এবং দলটি এখন ঢাকায় রয়েছে। আগামী মাসে দলের সদস্যরা আইএমএফ পরিচালনা পর্ষদের কাছে তাঁদের প্রতিবেদন জমা দেবেন।


জর্জিয়েভা বলেন, আইএমএফ বোর্ড দলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ঋণদান কর্মসূচি শুরু করতে পারে অথবা গত বছরের শুরুর দিকে চালু হওয়া বিদ্যমান সহায়তা কর্মসূচির আওতায় আরও ঋণ দিতে পারে। এছড়া বাংলাদেশকে ‘পরিবর্তিত দেশ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। তিনি বর্তমান বাংলাদেশকে ‘বাংলাদেশ ২.০’ আখ্যা দিয়ে দেশের সংস্কারের উদ্যোগকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের সময় আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাংলাদেশের সংস্কার পরিকল্পনায় আইএমএফের সমর্থন প্রকাশ করে বলেন, ‘এটি অন্য দেশ, এটি বাংলাদেশ ২.০।’  বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও পরিবহনবিষয়ক উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান ও ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ড. দেবপ্রিয় দেশের অর্থ প্রদানের ভারসাম্য জোরদার করতে আইএমএফের সহায়তার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, বিনিময় হার (এক্সচেঞ্জ রেট) স্থিতিশীল করতে আইএমএফের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে।


মাহফুজ আলমকে আন্দোলনের ‘নেপথ্য কারিগর’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন ড. ইউনূস

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডারস স্টেজ’ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অনুষ্ঠান মঞ্চে তিনি তার দীর্ঘদিনের বন্ধু সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথার ফাঁকে সফরসঙ্গী তিন জনকে পরিচয় করিয়ে দেন। মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা তার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আব্দুল্লাহকে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরে সরকার পতন আন্দোলনের ‘নেপথ্য কারিগর’ (বিহাইন্ড দ্য হোল) হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন।

‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডারস স্টেজ’ বক্তব্যে ড. ইউনূস তার বক্তব্য শুরু করেন সাবেক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার স্মৃতিচারণ দিয়ে। কীভাবে প্রায় ৪০ বছর আগে এক প্রায় অপরিচিত মার্কিন শহরের গভর্নর তার বন্ধু হয়ে উঠলেন, কীভাবে ধীরে ধীরে ক্লিনটনের উদ্যোগে শুরু হওয়া গ্রামীণ কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫টি গুরুত্বপূর্ণ শহরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ‘গ্রামীণ আমেরিকা’র এখন প্রায় ২ লাখ সদস্য রয়েছেন, যাদের সবাই নারী। তারা মোট দেড় হাজার কোটি ডলারের ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ১০ বছরে এই ঋণ বিতরণের পরিমাণ ৪ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে। তার বক্তব্যের সময় বারবার হাততালি দিতে থাকেন উপস্থিত শ্রোতারা। এসময় তার বুদ্ধিদীপ্ত বিভিন্ন কথায় মানুষ বারবার হেসে ফেলছিলেন।

বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে সামনে এগিয়ে আসেন ক্লিনটন। বন্ধু ড. ইউনূস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ড. ইউনূস তার দেখা একমাত্র বয়স্ক ব্যক্তি, যাকে নেতৃত্বে পেতে তরুণ সমাজ মরিয়া হয়েছিল। এমন হাস্যরসের পরেই বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট মাসের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সেখানে ছাত্রদের অবদান তুলে ধরেন ড. ইউনূস। এই অনুষ্ঠানে কয়েকজন শিক্ষার্থীও উপস্থিত আছেন জানিয়ে তাদের মঞ্চে আসার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমসহ তিন জন স্টেজে আসেন। বিল ক্লিনটনও তাদের নাম শুনে হাততালি দেন। ৩ জনের মধ্যে একজন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা তিথি।

তরুণ নেতারা মঞ্চে উপনীত হলে ড. ইউনূস বলেন, তারা যেভাবে কথা বলে, সেভাবে আমি কাউকে কোনোদিন বলতে শুনিনি। নতুন বিশ্ব গড়তে, নতুন বাংলাদেশ তৈরিতে তারা প্রস্তুত। আপনাদের অনুরোধ করছি তাদের পাশে থাকবেন, যেন তাদের এই স্বপ্ন পূরণ হয়। আমাদের সবারই এই দায়িত্ব নিতে হবে। এ সময় ক্লিনটনের হাত ধরে ইউনূস বলেন, ‘তুমি তো আমাদের সঙ্গে থাকবেই।’

ড. ইউনূস আরও বলেন, তাদের (তরুণ নেতা) দেখতে আর ১০টা মানুষের মতোই লাগবে আপনাদের। কিন্তু তাদের কথা শুনলে, তাদের কাজ দেখলে আপনারা অবাক হয়ে যাবেন। তারা পুরো দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের লক্ষ্য থেকে পিছপা হয়নি। তাদের বক্তব্য ছিল, মেরে ফেললেও আমরা পথ ছাড়বো না।

এসময় মাহফুজ আলমকে সামনে এগিয়ে নিয়ে তিনি বলেন, ‘মাহফুজ হচ্ছে আন্দোলনের পেছনের কারিগর। যদিও সে এটা স্বীকার করতে চায় না। বলে, সে একা নয়, আরও অনেকে (মাস্টারমাইন্ড) আছে। কিন্তু এরইমধ্যে সে এই গণ-অভ্যুত্থানের পেছনের কারিগর হিসেবে পরিচিত।’  

‘এই আন্দোলনটা খুব সুশৃঙ্খল ছিল’ উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা হঠাৎ করে হয়েছে এমন কিছু নয়। খুবই গোছানো আন্দোলন। এছাড়াও এত বড় আন্দোলন হয়েছে, মানুষ জানতো না কে আন্দোলনের লিডার? যার ফলে একজনকে আটক করা যেতো না। বলাও যেতো না যে একজনকে আটক করলে আন্দোলন শেষ।’

মাহফুজকে দেখিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘তার কথা শুনলে সারা পৃথিবীর যেকোনও তরুণ অনুপ্রাণিত হবে। তারা নতুন বাংলাদেশ তৈরি করবে। তাদের সফলতার জন্য আপনার প্রার্থনা করবেন। তাদের জন্য হাততালি হোক।’ এ সময় বিল ক্লিনটনসহ সবাই হাততালি দিয়ে সম্মান জানান।


ক্লিনটনকে আন্দোলন গোছালো ছিল বললেন ড. ইউনূস

বাংলাদেশের তরুণেরাই নতুন বাংলাদেশ গড়বেন বলে আশা ব্যক্ত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সম্প্রতি ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ আন্দোলন খুব পরিকল্পিতভাবে (অগোছালো নয়) চালিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিছুই হঠাৎ হয়নি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছেন ড. ইউনূস। গতকাল মঙ্গলবার নিউইয়র্কে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রতিষ্ঠান ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’–এর একটি আয়োজনে অংশ নেন তিনি। সেখানেই অধ্যাপক ইউনূস এ কথাগুলো বলেন। জ্যাকসন হাইটসে আয়োজন করা হয় এ অনুষ্ঠান।

অনুষ্ঠানে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিল ক্লিনটনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও সম্পর্কের প্রথম দিনের গল্প, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কাহিনি এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের নানা বিষয় তুলে ধরেন। এই অনুষ্ঠানের মঞ্চে ড. ইউনূস তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলার ফাঁকে সফরসঙ্গীদের তিনজনকে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বিশেষ সহকারী মাহফুজ আব্দুল্লাহকে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরে সরকার পতনের আন্দোলনের কারিগর হিসেবে উল্লেখ করেন।

কথা বলার এক পর্যায়ে মাহফুজকে সামনে এগিয়ে দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পেছনের কারিগর মাহফুজ। যদিও মাহফুজ সব সময় বলে, সে একা নয়, আরও অনেকে আছে। যদিও সে গণ-অভ্যুত্থানের পেছনের কারিগর হিসেবে পরিচিত।’

ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘এটি (ছাত্র আন্দোলন) খুব গোছালো ছিল। এমনকি লোকজন জানতেন না, কারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই, আপনি একজনকে ধরে ফেলে বলতে পারবেন না, ঠিক আছে, আন্দোলন শেষ। তাঁরা যেভাবে কথা বলেছেন, তা সারা বিশ্বের তরুণদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই।’


অনুষ্ঠানের শুরুতেই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন অধ্যাপক ইউনূসকে বাংলাদেশের তরুণ নাগরিকদের ডাকে সাড়া দিয়ে দায়িত্বগ্রহণকারী নেতা বলে পরিচয় করিয়ে দেন। এ সময় পুরো হল করতালিতে ফেটে পড়ে। দুই নেতা পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন।

বিল ক্লিনটন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, আমার জানা মতে, ‘আপনিই (ড. ইউনূস) একমাত্র বয়স্ক ব্যক্তি, যাঁকে দেশের তরুণেরা তাঁর নিজের অসাধারণ অর্জনের জন্য ক্ষমতায় বসিয়েছে।’

এদিকে ড. ইউনূস তাঁর বক্তব্য শুরু করেন বিল ক্লিনটনের সঙ্গে তাঁর প্রথম যোগাযোগের ঘটনা উল্লেখ করে। বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন (১৯৮৬ সালে), যা তাঁকে অবাক করেছিল। আরকানসাসের একজন গভর্নর (সে সময় ক্লিনটন এ অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ছিলেন) ওই চিঠি পাঠান। চিঠিতে তাঁর সঙ্গে দ্রুত দেখা করতে চান বলে তিনি লিখেছিলেন।


এ প্রসঙ্গে মজার ছলে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমি জানতাম না, তিনি দ্রুত বলতে ঠিক কতটা দ্রুত বোঝাতে চেয়েছিলেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম, এরপর আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে আসব, আমি অবশ্যই যাব এবং আপনার সঙ্গে অবশ্যই দেখা করব।’


ড. ইউনূস বলেন, ‘তিনি আমাকে বলেছিলেন, এটা (দেখা করা) খুবই জরুরি।’ উত্তরে আমি বলি, ‘আমি দেখছি, কীভাবে দ্রুত আসা যায়। আমি আসব, (তবে) আগেই আসতে পারব না। পরে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছি। এভাবেই আমাদের যোগাযোগের সূচনা হয়।’

দেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ড. ইউনূস তাঁদের কথাও বলেন। পুরো হল আবার করতালিতে ফেটে পড়ে। তিনি তাঁদের মঞ্চে ডেকে নিয়ে আসেন।


মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আরকানসাসের গভর্নর বুঝতে চাইছিলেন, গ্রামীণ ব্যাংক আসলে কী, যেটি নিয়ে লোকজন কথা বলছে। আমি তাঁদের কাছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করি। তিনি ও হিলারি উভয়ই সেখানে একটি হোটেল কক্ষে বসে ছিলেন। ওখানেই আমাকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সব শুনে তিনি বললেন, ‘‘আমাদের এটা দরকার। আমরা কত দ্রুত এটা আরকানসাসে পেতে পারি।’’ এটাই এই গল্পের শুরু।’


‘তাই, আমি তাঁর আয়োজনে আরকানসাস ঘুরতে যাই। আমি আরকানসাসের গ্রামাঞ্চল ঘুরে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখি। লোকজন বন্ধ দোকানের চারপাশে বসে আছেন। কারণ, সেখানকার অর্থনীতি পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আমার সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, আমাকে ওই সব মানুষকে দেখিয়ে বলেন, ‘‘তাঁরা কি কিছু করতে পারবেন?’’ আমি বলি, অবশ্যই, তাঁরাই যা করার করতে পারবেন’, বলেন অধ্যাপক ইউনূস।


ড. ইউনূস বলেন, ‘ওইসব লোক কিছু করতে পারবেন, এটা তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। ওটাই ছিল শুরু। বিল বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, আমরা একটা (গ্রামীণ ব্যাংক) করতে চলেছি।’’ কীভাবে এটি কাজ করবে, আমি বুঝিয়ে বললাম। এভাবেই সেখানে গ্রামীণ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হলো। হিলারি দায়িত্ব নিলেন। তিনি (বিল) গভর্নর ছিলেন এবং এটা করতে চাইলেন। এটাই এর শুরু। তবে আমি বুঝতে পারিনি, ঠিক কেন তাঁর জন্য বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’


অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘তিনি (বিল) প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে নামেন। তখন আমি বিষয়টা বুঝতে পারি। তিনি গভর্নর ছিলেন এবং এখন প্রেসিডেন্ট হতে চান। তিনি আমাকে বলেন, ‘‘আমি যখন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা করব, তখন আপনি অবশ্যই উপস্থিত থাকবেন।’’ আমি বুঝছিলাম না, কেন তিনি আমাকে চাইছেন, আমার উপস্থিত থাকার কথা বলছেন। তখন তিনি বলেন, ‘‘যদি আমি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হই। আমি যুক্তরাষ্ট্রের কোনায় কোনায় গ্রামীণ প্রকল্প ছড়িয়ে দেব।’’’


উপস্থিতি ব্যক্তিদের উদ্দেশে এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান বলেন, ‘আপনাদের কি মনে হয়, লোকজন খুশি হয়েছিলেন? পরদিন তাঁকে (বিল) নিয়ে খবর প্রকাশ পায়। বলা হয়, তিনি একজন উন্মাদ। আমেরিকানদের কী করতে হবে, সেটি বলার জন্য তিনি বাংলাদেশ থেকে একজনকে নিয়ে এসেছেন। এটা কীভাবে সম্ভব।’


মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তিনি চেষ্টা ছাড়েননি। তিনি বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেন, কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কখনো এর গুরুত্বের কথা বলা বন্ধ করেননি। কীভাবে অল্প অর্থের সাহায্যে মানুষকে বদলে ফেলা যায় এবং এটি কত গুরুত্বপূর্ণ, সেটি বলা কখনো বন্ধ করেননি তিনি। এটাই ছিল শুরু এবং তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও তা অব্যাহত ছিল।’


অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘তিনি (বিল) এটি করতে চেয়েছেন। সবকিছু দেখতে এরপর হিলারি মেয়ে চেলসিকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। আমি চেলসিকে এখানে (যুক্তরাষ্ট্র) দেখেছিলাম। তাঁরা চার দিন বাংলাদেশে আমাদের সঙ্গে কাটান, গ্রামীণ পোশাক পরেন; যা গ্রামাঞ্চলে তাঁতে খুব সাধারণভাবে তৈরি করা হয়।’

ড. ইউনূস বলেন, ‘চার দিনই গ্রামের তাঁতিদের তৈরি পোশাক পরেন তাঁরা (হিলারি ও চেলসি)। স্থানীয় এক তরুণ তাঁদের পোশাকের নকশা করেছিলেন। সবাই বলেছিলেন, ‘‘তিনি (হিলারি) কী পোশাক পরেছেন, কীভাবে আপনি এটি করলেন। কে পোশাকের নকশা করেছে।’’ আমি এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কেন তাঁরা প্রশ্ন করছিলেন, সেটাও জানতাম না।’ ‘তবে তাঁরা খুবই কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্টলেডি যেসব পোশাক পরছেন, সেগুলো খুব সাধারণ কাপড়ে তৈরি, গ্রামের তাঁতিরা যা তৈরি করেছেন। এটি ওইসব মানুষের জন্য দারুণ সম্মানের; যাঁরা নিজের হাতে এসব তৈরি করেন এবং বছরের পর বছর ধরে তাঁরা এটি করে আসছেন’, বলেন ড. ইউনূস।


ড. ইউনূস বলেন, ‘এরপর বিল ক্লিনটন (বাংলাদেশে) এলেন। প্রথমেই তিনি বললেন, ‘‘নাশতার টেবিলে আমি এ আলোচনা আর নিতে পারছি না। সবাই বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলছেন। আমি জানি না, তাঁরা কী নিয়ে কথা বলছেন।’’

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমি বুঝতে পারছিলাম না, বাংলাদেশে কী ঘটছে। হঠাৎ বাংলাদেশের সব তরুণ একত্র হয়েছেন এবং বলছেন, যথেষ্ট হয়েছে। আমরা আর এসব (অন্যায়, বৈষম্য) সহ্য করব না। তাঁরা সহ্য করেননি, তাঁরা সরকারের (ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকারের) ছোড়া গুলির সামনে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন।


‘অসহায় মানুষের প্রতি তাঁর (বিল) অনুভূতি এতটাই তীব্র ছিল এবং এখনো আছে। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আরকানসাসে গ্রামীণ প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়নি। গতি কমে গিয়েছিল, কিন্তু বন্ধ হয়নি’, বলেন মুহাম্মদ ইউনূস। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘শিকাগোতে একটি প্রকল্প শুরু হয়েছিল। এখন এটি বড় আকারে গ্রামীণ (প্রকল্প) হয়ে আসছে। আমেরিকায় গ্রামীণ আমেরিকা শুরু হয়েছে। এখানে নিউইয়র্ক সিটিতে, জ্যাকসন হাইটসে। এটি খুবই ছোট এক প্রকল্প ছিল এবং পরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এখন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে গ্রামীণ আমেরিকার ৩৫টি শাখা রয়েছে। প্রতিটি বড় শহরে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা আছে। এখানে গ্রামীণ ব্যাংকের গ্রাহক প্রায় দুই লাখ এবং ঋণগ্রহীতাদের শতভাগ নারী।’


‘এটা তাঁর (বিল) স্বপ্ন ছিল। এখন এসব ব্যাংক থেকে বছরে ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়া হয়। আমরা (গ্রামীণ ব্যাংক, আমেরিকা) এখন এ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। আমরা বছরে ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিই, কোনো জামানত ছাড়া, কোনো কিছু ছাড়া এবং সবাই সময়মতো ঋণ পরিশোধ করেন’, বলেন অধ্যাপক ইউনূস।


অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আগামী ১০ বছরে আমাদের (গ্রামীণ ব্যাংক, আমেরিকা) এই ঋণদানের পরিমাণ বছরে ৪০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এটা দারুণ এক গল্প, যেটা তিনি (বিল) শুরু করেছিলেন। আমরা (বাংলাদেশে) সবে একটি ব্যাংক হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছি। ১৯৮৩ সালে আমরা ব্যাংক হিসেবে নিবন্ধিত হই।’

‘১৯৮৬ সালে বিল যখন আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, ওই সময় এটা ছিল ছোট্ট একটি পরিকল্পনা। কল্পনা করতে পারেন, তিনি কত দূরের ভবিষ্যৎ দেখতে পান। এটি সেই কোথাকার ছোট্ট একটি পরিকল্পনা, যেটির বিষয়ে তিনি তখনো ঠিকমতো জানেনই না, এটি কী হতে পারে। তখনই তিনি আরকানসাসে সেটি চেয়েছিলেন’, বলেন অধ্যাপক ইউনূস।

নোবেলজয়ী এই অধ্যাপক বলেন, ‘এভাবেই আমার ও বিলের, বিলের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমরা অনেকটা পথ এগিয়ে যাই। এটি আমাকে কিছু করার প্রেরণা দেয়। আমি এর পর থেকে নিয়মিত সিজিআইয়ের (ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ) অনুষ্ঠানে অংশ নিতে থাকি এবং হঠাৎই যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। এখানে ফিরতে পেরে আমি খুবই খুশি।’

মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আপনারা বিল সম্পর্কে এমন অনেক গল্প শুনেছেন। তবে খুব সম্ভবত, অনেক মানুষ ওই গল্পটা জানেন না, যেটা আমি জানি। আমি তাঁকে খুব কাছে থেকে দেখেছি, তিনি আসলে কেমন। আমি তাঁর, হিলারি ও চেলসির বন্ধু হতে পেরে খুবই গর্বিত। এটি চমৎকার একটি সম্পর্ক।’

ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘তিনি (বিল) যেখানেই যেতেন, এমনকি আজও যেখানেই যান, ওই গল্প বলেন। আমার ও আমাদের কাজের সঙ্গে কী ঘটেছে, তা কখনো ভুলে যাননি তিনি। আমার চমৎকার একজন বন্ধু হয়ে থাকার জন্য (বিলকে) অনেক অনেক ধন্যবাদ।’

এরপর বিল ক্লিনটন চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ধরেন। হল আবার করতালিতে ফেটে পড়ে। ক্লিনটন বলতে শুরু করেন, ‘আমার জানামতে, আপনিই একমাত্র বয়স্ক ব্যক্তি, যাঁকে দেশের তরুণেরা তাঁর নিজের অসাধারণ অর্জনের জন্য ক্ষমতায় বসিয়েছে। কারণ, তিনি সেটা অর্জন করার চেষ্টা করেন, যেটি আমাদের সবার করা উচিত। আমাদের সবাইকে ভবিষ্যতের কথা ভাবা উচিত। আমি আপনার জন্য খুবই গর্বিত, আপনার প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।’


ক্লিনটন বলেন, ‘আমি মনে করি, আমাদের সবার বাংলাদশের মঙ্গল কামনা ও তাদের সহায়তার জন্য যা করা দরকার, তা করা উচিত। এমন কাউকে ঋণ দেওয়া উচিত, যিনি জানেন, সেটি কীভাবে ফেরত দিতে হয়।’


এরপর ক্লিনটন ড. ইউনূসকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিতে যান। তখন ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলতে চান। তখন তিনি বলেন, ‘তরুণেরা সব সময় তরুণদের নিয়ে কথা বলতে চান। তরুণদেরই নেতৃত্ব দেওয়া উচিত। আমাদের মতো বুড়োদের নয়।’

এ সময় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম না, বাংলাদেশে কী ঘটছে। হঠাৎ বাংলাদেশের সব তরুণ একত্র হয়েছেন এবং বলছেন, যথেষ্ট হয়েছে। আমরা আর এসব (অন্যায়, বৈষম্য) সহ্য করব না। তাঁরা সহ্য করেননি, তাঁরা সরকারের (ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকারের) ছোড়া গুলির সামনে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন।’


‘তরুণেরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমি কিছু ভিডিও দেখেছি। তাঁরা সেখানে এমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বলছিলেন, ‘‘আমাদের কতজনকে আপনারা হত্যা করতে পারবেন। আমরা এখানে আছি, আমাদের হত্যা করুন। কিন্তু আমরা বিশ্বকে পরিবর্তন করেই ছাড়ব, আমরা বাংলাদেশকে পরিবর্তন করেই ছাড়ব।’’ এটাই তাঁদের প্রতিজ্ঞা ছিল, তাঁরা নতুন একটি বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছেন’, বলেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি আরও বলেন, ‘পরবর্তী বাংলাদেশ হবে তরুণদের বাংলাদেশ। তাঁরা এই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। আগের সরকার চলে যাওয়ার পর তাঁরা আমাকে আমন্ত্রণ জানান। আমাকে দেশের নেতৃত্ব দিতে আমন্ত্রণ জানান। আমি সেটাই করার চেষ্টা করছি। তরুণেরা জাতিকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সেটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি।’


এ বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, ‘তাঁরা যেভাবে (আন্দোলন) করেছেন, তাতে পুরো জাতি এক হয়েছে। পুরো দেশের মানুষ এবার তরুণদের সমর্থন দিয়েছেন।’ এ সময় সবাই হাততালি দিয়ে ওঠেন। তখন ড. ইউনূস বিল ক্লিনটনের হাত ধরে বলেন, ‘এটি বাস্তবায়নে (তরুণদের আকাঙ্ক্ষা) যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের সমর্থন পেয়ে আমি খুব খুশি। আমরা আরও এগিয়ে যেতে চাই। নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই। তাঁরা (তরুণেরা) বলেছেন আমরা ‘‘রিসেট বাটন’’ চেপেছি। সব পুরোনো শেষ হয়েছে। এখন আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ব।’

দেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ড. ইউনূস তাঁদের কথাও বলেন। পুরো হল আবার করতালিতে ফেটে পড়ে। তিনি তাঁদের মঞ্চে ডেকে নিয়ে আসেন।


এ সময় মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘দেশ গড়তে, নিজেদের গড়তে যে শব্দে, যে ভাষায় তাঁরা (আন্দোলনকারীরা) কথা বলেছেন, তা অসাধারণ। আমি আগে কখনো এভাবে কাউকে কথা বলতে শুনিনি। তাঁরা তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ করতে প্রস্তুত। দয়া করে তাঁদের সাহায্য করুন, সমর্থন করুন। তাঁদের স্বপ্ন যেন সত্য হয়। আমরা একসঙ্গে এ দায়িত্ব নিতে পারি। এ স্বপ্ন পূরণে আপনি (ক্লিনটন) আমাদের সঙ্গে থাকবেন।’ মঞ্চে আসা আন্দোলনকারী তরুণদের প্রশংসা করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘তাঁদের দেখতে অন্য তরুণদের মতোই মনে হয়। আপনি তাঁদের আলাদা করে মনে রাখতে পারবেন না। কিন্তু আপনি যখন তাঁদের কথা শুনবেন, তাঁদের কাজ দেখবেন, কেঁপে উঠবেন। তাঁরা পুরো দেশকে নাড়া দিয়েছেন।’


ছাত্র–জনতার আন্দোলন প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এ আন্দোলন খুব পরিকল্পিতভাবে (অগোছালোভাবে নয়) চালিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিছুই এমনিতে হয়নি। এটি খুব গোছালো ছিল। এমনকি, লোকজন জানতেন না, কারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই, আপনি একজনকে ধরে ফেলে বলতে পারবেন না, ঠিক আছে আন্দোলন শেষ। তাঁরা যেভাবে কথা বলেছেন, তা সারা বিশ্বের তরুণদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।’ পরিশেষে ড. ইউনূস বলেন, ‘তরুণেরাই গড়বেন নতুন বাংলাদেশ, তাঁদের সাফল্য কামনা করি।’


জেবি/এসবি