জুলাই আন্দোলনের আত্মত্যাগ বনাম অনুদানের রাজনীতি


Janobani

জনবাণী ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮:২০ অপরাহ্ন, ৪ঠা জুলাই ২০২৫


জুলাই আন্দোলনের আত্মত্যাগ বনাম অনুদানের রাজনীতি
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

জুলাই আন্দোলনের চেতনা ছিল গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা ও রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের ন্যায্য অধিকার পুনরুদ্ধারের প্রতীক। সেই চেতনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত একটি চলচ্চিত্র ‘দ্য রিমান্ড’ যখন সেন্সর বোর্ডের অনুমোদন না পেয়ে স্থবির হয়ে পড়ে, অথচ একই আন্দোলনের নামে তথাকথিত “সরকারি ঘরানার” চলচ্চিত্রগুলো কোটি কোটি টাকার সরকারি অনুদান পেয়ে যায়, তখন এই বৈপরীত্য কেবল নীতিগত ব্যর্থতাই নয়, এটি রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের উপর এক নির্মম বিদ্রুপ।


বৃহস্পতিবার (০৩ জুলাই) নিজের ভেরিফাইড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়েছেন অভিনেতা আবীর চৌধুরী। আমাদের পাঠকদের জন্য তার ফেসবুক পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো:  


তার পোস্টে তিনি বলেন, আমি সেই আন্দোলনের সময় রাজপথে ছিলাম। একজন শিল্পী হিসেবে সেই অভিজ্ঞতা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। সেই অন্তর্দাহ ও দায়বোধ থেকেই আমি অভিনয় করেছি ‘দ্য রিমান্ড’ চলচ্চিত্রে, একটি সাহসী শিল্পপ্রয়াস, যা প্রযোজনা করেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট বেলায়েত বেলাল এবং পরিচালনা করেছেন প্রতিশ্রুতিশীল নির্মাতা আশরাফুর রহমান।


আরও পড়ুন: শাকিবের সঙ্গে আবারও ছবি পোস্ট করলেন মিষ্টি জান্নাত


তিনি আরও বলেন, এই চলচ্চিত্রে আমার সহশিল্পী ছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম, কিংবদন্তি নির্মাতা ও অভিনেতা কাজী হায়াৎ, মারুফ আকিব এবং সালহা খানম নদি ও লুৎফুর রহমান জর্জ’র মতো প্রতিভাবান ও মননশীল শিল্পীরা। ‘দ্য রিমান্ড’ শুধুমাত্র একটি চলচ্চিত্র নয় এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল, এটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা, এবং এটি সেই সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচারের আর্তনাদ যারা বারবার উপেক্ষিত, বঞ্চিত এবং ভুলে যাওয়া ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ঠাঁই পায় না।




অভিনেতা বলেন, তবে এই যাত্রাপথ এতটা সহজ ছিল না। আন্দোলনের মতো সংবেদনশীল একটি বিষয় নিয়ে কাজ করায় অনেক শিল্পী শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়িয়েছেন এমনকি কেউ কেউ শুটিংয়ের দিন সকালেও পরিচালককে ফোন করে জানিয়েছেন যে, তারা কাজ করতে পারবেন না। মায়ের বা বাবার চরিত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়ও কেউ সাহস দেখাননি। এই প্রেক্ষাপটে যারা এগিয়ে এসেছেন, তারা শুধু অভিনয় করেননি তারা একটি আদর্শের পাশে দাঁড়িয়েছেন।


আবির চৌধুরী জানান, কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ড এখনো পর্যন্ত কোনো স্পষ্ট কারণ দেখায়নি বা আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ প্রদান করেনি। ‘দ্য রিমান্ড’ চলচ্চিত্রটিকে কার্যত আটকে দেওয়া হয়েছে এক রহস্যজনক নীরবতা ও প্রশাসনিক জটিলতার মাধ্যমে। এতে আমাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে এই সিদ্ধান্ত কেবল একটি চলচ্চিত্রকে থামানোর চেষ্টা নয়, বরং এটি একটি আন্দোলনের চেতনা, ইতিহাস এবং আদর্শকে নীরবে হত্যার অপচেষ্টা।


আরও পড়ুন: আমিই স্বৈরাচারকে হটাই কিন্তু আমিই যেন স্বৈরাচার: এলিনা শাম্মী


আবির চৌধুরী আরও জানান, তবে আশার বিষয়ও আছে। প্রযোজক ও পরিচালক সূত্রে জানতে পেরেছি, চলচ্চিত্রটি ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক উৎসবের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে যেখানে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের অনুমোদন প্রয়োজন পড়ে না। অর্থাৎ, দেশীয় কর্তৃপক্ষ চুপ থাকলেও, বিশ্বের দরবারে এই চলচ্চিত্র তার সত্য ও শিল্পমান নিয়ে কথা বলবে। এটি কেবল শিল্পের বিজয় নয়, আদর্শের পক্ষেও এক নীরব প্রতিবাদ।


অভিনেতা আক্ষেপ করে বলেন, বলতেই হয়, তথাকথিত অনুদান বিতরণের স্বেচ্ছাচারিতার প্রেক্ষাপটে জাকিয়া বারী মম’র পদত্যাগ নিছক একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ছিল না এটি ছিল এক স্পষ্ট, নির্ভীক ও নৈতিক প্রতিরোধের প্রকাশ।তথ্যমন্ত্রণালয়ের অনুদান কমিটি থেকে পদত্যাগ করে তিনি প্রমাণ করেছেন একজন সত্যিকার শিল্পী কখনোই আদর্শ ও বিবেকের সাথে আপস করেন না। যখন অনুদান বণ্টন একটি শিল্পভিত্তিক প্রক্রিয়া না হয়ে রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা, গোষ্ঠীগত সুবিধা ও স্বজনপ্রীতির অবাধ খেলায় পরিণত হয়, তখন নীরবতা অপরাধের সামিল। অভিনেত্রী মম সেই অপরাধে অংশ না নিয়ে নীরবতার শৃঙ্খল ভেঙেছেন। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, একজন শিল্পীর সবচেয়ে বড় শক্তি তার নৈতিক অবস্থান। এই সাহসী সিদ্ধান্ত শুধু একজন ব্যক্তির বিবেকের পরিচয় নয়, বরং এটি দেশের সব শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীর জন্য একটি আদর্শ, একটি প্রতিবাদের মাইলফলক। মম আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন শিল্প যখন রাষ্ট্রের কাছে মাথা নত করে, তখন কণ্ঠস্বর হারায় সমাজ। আর যখন শিল্প প্রতিবাদ করে, তখন ইতিহাস তাকে মনে রাখে।


চিত্রনায়ক বলেন, আমরা এখন এমন একটি সময় অতিক্রম করছি, যেখানে অনুদানপ্রাপ্তদের তালিকায় বারবার উঠে আসছে মন্ত্রী-সচিবদের আত্মীয়, রাজনৈতিক নেতা কিংবা তাদের ঘনিষ্ঠরা। অথচ বহু প্রতিভাবান পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও অভিনেতা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত ও বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন। এটি কেবল অনৈতিক নয়, এটি আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতির ভবিষ্যতের জন্য চরম অশনিসংকেত। এই নীতিগত সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে এখনই সময় অনুদান ব্যবস্থার ঢেলে সাজানোর। আমি একটি প্রস্তাব দিচ্ছি, চলচ্চিত্র অনুদান ব্যবস্থায় একটি ব্যালেন্সড ইনভেস্টমেন্ট স্ট্রাকচার চালু করা উচিত, যেখানে নির্মাতাকে তার প্রস্তাবিত চলচ্চিত্র বাজেটের কমপক্ষে ৪০% নিজস্ব অর্থায়নে বিনিয়োগ করতে হবে এবং তার যথাযথ প্রমাণ তথ্য মন্ত্রণালয়ে দাখিল করতে হবে।


আরও পড়ুন: পৃথিবীর অন্য কোনো শহরকে কলকাতার মতো মনে হয় না: জয়া


এই কাঠামো বাস্তবায়ন হলে তিনটি প্রধান সুফল পাওয়া যাবে:


১.জবাবদিহিতা ও আন্তরিকতা নিশ্চিত হবে নির্মাতা নিজেই যখন বিনিয়োগ করবেন, তখন তিনি প্রকল্পটির সাফল্য ও মানের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবেন।


২.সরকারি অর্থের অপব্যবহার রোধ হবে যারা শুধুমাত্র সুবিধা নিতে চায়, তারা বাদ পড়বে।


৩.প্রতিভা ও উদ্ভাবনী চিন্তার পথ প্রশস্ত হবে গোষ্ঠী নির্ভর নয়, কাজ নির্ভর প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে।

পরবর্তী ৬০% অনুদান সরকার তখন যোগ্যতা, ধারণা ও বাস্তবায়ন সক্ষমতা যাচাই করে দিতে পারবে যা একটি যৌথ দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছতা ভিত্তিক চলচ্চিত্র উদ্যোগ নিশ্চিত করবে।




বর্তমানে এককভাবে ১০০% অনুদান প্রদানের পদ্ধতি কেবল অপচয়ই নয়, এটি পক্ষপাতদুষ্ট প্রভাবশালীদের হাতে পুরো প্রক্রিয়াকে জিম্মি করে ফেলছে। এই পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে সৃজনশীলতার মৃত্যু ডেকে আনবে, এবং শিল্পের প্রতি তরুণদের আগ্রহ কমিয়ে দেবে।


পরিশেষে চিত্রনায়ক আবির চৌধুরী আরও বলেন, অতএব, আমি একজন অভিনেতা, একজন আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী এবং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে দৃঢ়ভাবে বলছি যদি আমরা সত্যিকারভাবে জুলাই আন্দোলনের আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে চাই, তবে এখনই চলচ্চিত্র অনুদান ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। না হলে, ‘দ্য রিমান্ড’-এর মতো সত্যনিষ্ঠ চলচ্চিত্র শুধু অন্ধকারেই হারিয়ে যাবে না বরং জাকিয়া বারী মম’র মতো একজন নীতিবান শিল্পীর সাহসী অবস্থান এবং অসংখ্য মানুষের শিল্পের স্বপ্নও হারিয়ে যাবে ক্ষমতার অন্ধ গোষ্ঠীগত আগ্রাসনের ছায়ায়।


এমএল/