Logo

মাঠ পর্যবেক্ষণে দেখা দিল সুন্দরবনের বর্তমান সংকট

profile picture
জেলা প্রতিনিধি
৯ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১৬:৪৩
16Shares
মাঠ পর্যবেক্ষণে দেখা দিল সুন্দরবনের বর্তমান সংকট
ছবি: প্রতিনিধি

বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে প্রাকৃতিক সুরক্ষাবলয় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরবন। খুলনা বিভাগ ও ভারতের উত্তর–দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের বিস্তৃত এই ম্যানগ্রোভ বনভূমির ছয় হাজার বর্গকিলোমিটারই বাংলাদেশের অংশ।

বিজ্ঞাপন

১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য ও ১৯৯২ সালে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবন গড়ে উঠেছে পদ্মা–মেঘনা–যমুনা মোহনার অনন্য পরিবেশে। এটি শুধু বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঢাল নয়, বরং জীববৈচিত্র্যের ভরসাস্থল ও উপকূলীয় মানুষের জীবন–জীবিকার প্রধান নির্ভরতা।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ৩২ জন শিক্ষার্থী ১৭ থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবনে মাঠসমীক্ষায় অংশ নেন। প্রায় ১০০ ঘণ্টার এই ফিল্ডওয়ার্কে তাদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন বিভাগের দুই শিক্ষক প্রফেসর ড. অলক পাল এবং প্রফেসর ড. মাহবুব মুর্শেদ। মাঠসমীক্ষার অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করেছেন আফরিদা রিমা, সানজানা আমিন, মো. ইন্তিছার শাহাদ রাফি এবং মাহির তাজওয়ার তকি।

বিজ্ঞাপন

গবেষকদের মতে, এক সময় সুন্দরী গাছ সুন্দরবনের বৃক্ষবৈচিত্র্যের বড় অংশ দখল করে ছিল। শক্তিশালী শিকড়, ঘন কান্ড, মাটি ধরে রাখার ক্ষমতা এবং প্রাণীকুলের আবাসস্থল তৈরির জন্য এই গাছটি ছিল অপরিহার্য। মিঠাপানির প্রভাবে সুন্দরীর উচ্চতা ২৫ থেকে ৩০ মিটার পর্যন্ত হতো। কিন্তু শিক্ষার্থীদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অতিরিক্ত লবণাক্ততা বৃদ্ধি, টপ–ডাই ব্যাক রোগ, পুষ্টির ঘাটতি, জোয়ার–ভাটার চক্রের পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চাপ এবং মানবচাপ বৃদ্ধির কারণে সুন্দরী গাছের উচ্চতা ও ঘনত্ব ক্রমশ কমে যাচ্ছে। কিছু এলাকায় গাছের স্বাস্থ্যও মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আন্ধারমাণিকের মতো মিঠাপানির প্রভাব থাকা এলাকায় সুন্দরীর অবস্থান তুলনামূলক ভালো হলেও কচিখালি, কটকা, জয়মনি, হিরণ পয়েন্ট, করমজল, ডিমের চর ও কোকিলমণির মতো অধিক লবণাক্ততার অঞ্চলে সুন্দরী ক্রমশ বিরল হয়ে পড়ছে।

পর্যবেক্ষণকৃত ১০টি স্থানের বৈশিষ্ট্যও ছিল ভিন্নতর। আন্ধারমানিকে লবণ–মিঠাপানির সংমিশ্রণে সুন্দরীর ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে, যেখানে মাটি ছিল সিলটি–ক্লে ধরনের। কচিখালিতে টাইগার ফার্ন, ছন ও হেতালসহ নানা দেশজ উদ্ভিদের আধিক্য চোখে পড়ে, আর অভ্যন্তরের পুকুরগুলো বন্যপ্রাণীর পানির উৎস হিসেবে কাজ করে।

বিজ্ঞাপন

কটকা জামতলায় সেন্ডি মাটির কারণে দেশজ বৃক্ষবৈচিত্র্য বেশি দেখা যায়, আর কটকা অফিস এলাকায় কেওরা গাছই ছিল প্রধান, যা হরিণের মূল খাদ্য। ডিমের চরে সিল্ট জমে নতুন সেডিমেন্টেশন বেশি হয়, কোকিলমণিতে সক্রিয় জোয়ার–ভাটার প্রভাবে ক্লে মিশ্রিত মাটিতে গাছের স্বাস্থ্য তুলনামূলক ভালো।

হিরণ পয়েন্টে বন্যপ্রাণীর উপস্থিতির কারণে এলাকা বিশেষ গুরুত্ব পায়, যেখানে মাটি ছিল সিল্ট। জয়মনি এলাকায় চারদিকে বসতির কারণে লবণাক্ততা বেড়ে সুন্দরী গাছ কমে গেছে, দুবলার চর ছিল সেন্ডি মাটি ও উচ্চ লবণাক্ততার এলাকা, আর করমজল মূলত মৎস্যনির্ভর যেখানে মাটির ধরন ছিল সিল্ট।

এই এলাকার অন্যতম উদ্বেগজনক চিত্র ছিল বর্জ্য দূষণ। প্লাস্টিকের পাশাপাশি প্রায় সব জায়গায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ থার্মোকল পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞাপন

ধারণা করা হয়, মাছ ধরার বরফবাক্স ভেঙে থার্মোকল পানিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়ে জলজ প্রাণী, চারা ও উদ্ভিদজগতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দুবলার চর অঞ্চলে মৎস্য আহরণ ও ধর্মীয় উৎসবসংক্রান্ত বর্জ্য বেশি পাওয়া গেছে, কটকা ও জামতলা এলাকায় পর্যটন বর্জ্য এবং হিরণ পয়েন্টে নৌযানের বর্জ্যই ছিল দূষণের প্রধান উৎস।

বন্যপ্রাণীর সংকটও ছিল মাঠসমীক্ষার বড় উদ্বেগ। শিক্ষার্থীরা বলেন, কাকড়া ও হরিণ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর দেখা পাওয়া খুবই সীমিত ছিল। পর্যটনের শব্দদূষণ, মানুষের চলাচল, খাদ্যউদ্ভিদের অভাব, লবণাক্ত পরিবেশের পরিবর্তন এবং প্রাণীদের বনের গভীরে সরে যাওয়া—এসব কারণে বন্যপ্রাণীর উপস্থিতি কমে গেছে। এটি সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানের জন্য আশঙ্কাজনক।

বিজ্ঞাপন

প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিঘাতও সুন্দরবনকে ক্রমাগত দুর্বল করে দিচ্ছে। ২০০৭ সালের সিডর প্রায় ৩০ শতাংশ বনাঞ্চল ধ্বংস করে, বন্যপ্রাণীর আবাস ও মিঠাপানির স্তর ভেঙে দেয়। ২০০৯ সালের আইলা লবণাক্ততা বাড়িয়ে সুন্দরীর টপ–ডাইং রোগ বিস্তার ঘটায়। পরবর্তী ঘূর্ণিঝড় রুয়ানু (২০১৬) এবং আম্পান (২০২০)–এও নতুন করে ক্ষতি হয়।

শিক্ষার্থীরা মনে করেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, সঠিক নীতি এবং স্থানীয় মানুষের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। তাঁদের মতে, সুন্দরবন রক্ষায় মিঠাপানির প্রবাহ বৃদ্ধি, অধিক লবণ–সহনশীল চারা উৎপাদন, পরজীবী নিয়ন্ত্রণে জীববৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার, প্লাস্টিক–থার্মোকল নিষিদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ, সুন্দরী রোগ গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন, ভারত–বাংলাদেশ যৌথ নদী ও বাঘ সংরক্ষণ উদ্যোগ জোরদার করা প্রয়োজন।

বিজ্ঞাপন

একইসঙ্গে বন্যপ্রাণীর জন্য নীরব অঞ্চল ঘোষণা, করিডর পুনর্গঠন, ড্রোন–ক্যামেরা নজরদারি এবং ঘূর্ণিঝড়–পরবর্তী দ্রুত পুনর্গঠন বিভাগেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাঁদের মতে, কমিউনিটি–ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা চালু হলে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণে সুন্দরবন আরও টেকসইভাবে রক্ষা পাবে।

সুন্দরীর সংকটই আজ সুন্দরবনের সংকট। মাঠ পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা বলছে, চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা এই বনকে রক্ষা করতে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। কারণ সুন্দরী বাঁচলে সুন্দরবন বাঁচবে, আর সুন্দরবন বাঁচলে বাঁচবে উপকূল, মানুষ ও জীববৈচিত্র্য।

জেবি/এসএ
Logo

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ

মোঃ শফিকুল ইসলাম ( শফিক )

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ৫৭, ময়মনসিংহ লেন, ২০ লিংক রোড, বাংলামটর, ঢাকা-১০০০।

ফোনঃ 02-44615293

ই-মেইলঃ dailyjanobaninews@gmail.com; dailyjanobaniad@gmail.com

জনবাণী এর সকল স্বত্ব সংরক্ষিত। কপিরাইট © ২০২৫

Developed by: AB Infotech LTD

মাঠ পর্যবেক্ষণে দেখা দিল সুন্দরবনের বর্তমান সংকট