নিঃশব্দ দৃষ্টিতেই সীমাহীন শোক তারেক রহমানের

মাকে হারিয়ে গভীর এক নীরবতায় ডুবে গেছেন তারেক রহমান। চোখে-মুখে কোনো উচ্চকিত আহাজারি নেই, কিন্তু নিঃশব্দ দৃষ্টিতেই যেন জমে উঠেছে সীমাহীন শোক। জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে তিনি ছিলেন মায়ের শয্যাপাশেই। শেষ সময় পর্যন্ত রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে থেকে মায়ের চিকিৎসা ও পাশে থাকার দায়িত্ব পালন করেন।
বিজ্ঞাপন
মায়ের মৃত্যুর পর তিনি বাসায় ফিরে যান। সেখানে দোয়া ও মোনাজাত শেষে বেরিয়ে পড়েন গুলশানে দলের রাজনৈতিক কার্যালয়ের দিকে। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) দুপুরের দিকে বিএনপির চেয়ারপারসনের ওই কার্যালয়ে তারেক রহমানের উপস্থিতিতে পুরো পরিবেশটাই বদলে যায়। মাত্র কয়েক দিন আগেই ১৭ বছর পর তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছিল, সেদিন সেখানে ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র—নিস্তব্ধতা আর শোকের ভার।
নেতাকর্মী ও সমর্থকদের চোখে জল, কার্যালয়জুড়ে বিষণ্ন আবহ। সেই শোকের ছায়া পড়েছিল তারেক রহমানের মুখেও। কয়েক ঘণ্টা আগেও যে মুখে ছিল হাসির আভা, ভোরের সংবাদে সেটিই পরিণত হয় চিরস্থায়ী বেদনার প্রতিচ্ছবিতে। বৈঠকে বসে তিনি যেন পাথরের মতো স্থির—একদিকে মায়ের মৃত্যু, অন্যদিকে তাঁর রেখে যাওয়া রাজনৈতিক দায়িত্বের ভার। কোনটি আগে সামলাবেন, সেই প্রশ্নই যেন ভেসে উঠছিল তাঁর নির্বাক চোখে।
বিজ্ঞাপন
বেগম খালেদা জিয়ার শেষ সময়ের কথা জানিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, মঙ্গলবার ভোর ৬টায় এভারকেয়ার হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। তখন তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমান পাশেই ছিলেন। প্রথমে একাই আইসিইউতে ঢুকে মায়ের কাছে যান তিনি। পরে পরিবারের অন্য সদস্যরাও ভেতরে প্রবেশ করেন। শেষ মুহূর্তে দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন তারেক রহমান—নীরবে, অস্থির হৃদয়ে।
হাসপাতালের সেই শেষ প্রহরে তারেক রহমানের মানসপটে ভেসে উঠছিল মায়ের রাজনৈতিক সংগ্রাম, দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় তাঁর আপসহীন ভূমিকার স্মৃতি। দীর্ঘদিন দূরে থাকায় মায়ের সেবা করতে না পারার আক্ষেপও হয়তো তাঁকে তাড়া করছিল।
পিতা জিয়াউর রহমানকে হারানোর পর খুব অল্প বয়সেই মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে রাজপথে নামতে হয়েছিল তারেক রহমানকে। সময়ের সঙ্গে দেশের রাজনীতির উত্থান-পতন যেমন বদলেছে, তেমনি গভীর আঘাত এসেছে জিয়া পরিবারেও। সেই ধারাবাহিকতায় দেশছাড়া জীবন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন—সবই সইতে হয়েছে তাঁকে। একই পরিণতি নেমে এসেছিল ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর জীবনে। ২০১৫ সালে বিদেশের মাটিতে কোকোর মৃত্যু তারেক রহমানকে ভেঙে দিয়েছিল আরও একবার; ভাইকে শেষ দেখার সুযোগও পাননি তিনি।
বিজ্ঞাপন
এরপর কারাবরণ, দীর্ঘ অসুস্থতা—খালেদা জিয়ার জীবনও ছিল কণ্টকাকীর্ণ। গণঅভ্যুত্থানের পর মুক্তি পেয়ে বিদেশে চিকিৎসা নিলেও দেশের মানুষের আশা ছিল, তিনি আরও সময় পাশে থাকবেন। কিন্তু ২৩ নভেম্বর থেকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর উদ্বেগ বাড়তে থাকে। দেশ-বিদেশের সব ধরনের চিকিৎসা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাঁর শারীরিক অবস্থা উন্নতির পথে ফেরেনি।
খালেদা জিয়ার জীবনের আকাঙ্ক্ষা ছিল দেশের মাটিতেই থাকা, দেশের মানুষকে ছেড়ে কোথাও না যাওয়া। শেষ পর্যন্ত সেই আকাঙ্ক্ষাই যেন পূরণ হলো। হয়তো তিনি অপেক্ষা করছিলেন বড় ছেলের জন্য—তারেক রহমানের দেশে ফেরা দেখতে। সেই প্রত্যাবর্তনের রেশ কাটতে না কাটতেই তাঁকে বিদায় নিতে হলো মাকে হারানোর অসহনীয় বেদনা নিয়ে।
বিজ্ঞাপন
১৯৮১ সালে বাবাকে হারানোর পর, পরে ভাইকে হারিয়ে, এবার মাকেও হারালেন তারেক রহমান। বাবা ও ভাইয়ের শূন্যতা তিনি ভুলতে চেয়েছিলেন মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সেই আশ্রয়ও হারিয়ে গেল চিরতরে।
তবু বিদায়ের আগে খালেদা জিয়া যেন রেখে গেলেন এক নীরব বার্তা—সব প্রতিকূলতার মাঝেও দেশ ও মানুষের পাশে থাকার, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার। মাকে হারিয়ে একা হয়ে পড়া তারেক রহমানের সামনে পথ যে সহজ নয়, তা তিনি নিজেও জানেন। তবু গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে সেই কঠিন পথ পাড়ি দিতেই হবে—এই বাস্তবতাই যেন আজ তাঁর নীরব চোখে ফুটে উঠছে।








