ফিলিস্তিনের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মুসল্লিদের টার্গেট করছে ইসরায়েল

জেরুজালেমের বায়ত হানিনা এলাকায় ‘মসজিদুল হিজরাহ’র ভেতরে জুতা পায়ে ঢুকল দখলদার ইসরায়েলি এক পুলিশ সদস্য। নামাজরত এক যুবককে ডেকে নামাজ ভেঙে পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য করল। উদ্দেশ্য ছিল, পশ্চিম তীর থেকে ‘অবৈধভাবে’ জেরুজালেমে ঢুকে মসজিদে আশ্রয় নিয়েছে কি না তা যাচাই করা।
বিজ্ঞাপন
পুলিশ কর্মকর্তা মসজিদ থেকে বের হওয়ার আগে আরও এক ধাপ এগিয়ে ‘অতিরিক্ত শব্দ’ তৈরির অভিযোগে মুয়াজ্জিনের বিরুদ্ধে ৫ হাজার শেকেল (প্রায় দেড় হাজার মার্কিন ডলার) জরিমানা করল।
জেরুজালেমের বায়ত হানিনা এলাকার মানুষদের জন্য এ দৃশ্য নতুন নয়। তবে এই দৃশ্য নেটমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা সবাইকে ক্ষুব্ধ করে এবং বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠে।
এই ঘটনা ফিলিস্তিনজুড়ে মসজিদে হামলা, ধর্মীয় স্থাপনা বিধি-নিষেধ আরোপ এবং আজানের ওপর দমননীতির চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনকে নতুন করে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরলো। আল-আকসা মসজিদে প্রতিদিনই দখলদার বাহিনীর হামলা, তল্লাশি, এমনকি মাইক লাইনের তার কেটে দিয়ে আজান বন্ধ করার ঘটনা ঘটছে।
বিজ্ঞাপন
আজানের বিরুদ্ধে পুরনো ষড়যন্ত্র
ইসরায়েলে আজান বন্ধের আইনি প্রচেষ্টা শুরু হয় ২০১১ সালে। সে সময় নেসেটে আনা হয় ‘মুয়াজ্জিন আইন’ নামে একটি প্রস্তাব। যেখানে ‘যে কোনো উপাসনালয়ে’ মাইক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। যদিও এটি স্পষ্টতই মুসলিমদের মসজিদগুলোর বিরুদ্ধে ছিল।
বিজ্ঞাপন
২০১৬ সালে বিষয়টি নতুন মাত্রা পায়। ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা অভিযোগ তোলে, আজানের শব্দে তাদের বাচ্চারা ভয় পায়, বিশেষ করে ফজরের সময়। একই বছরের নভেম্বর মাসে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা আইন প্রণয়নের অনুমোদন দেয়, যাতে জেরুজালেম ও আশপাশের এলাকায় মাইক দিয়ে আজান দেওয়া নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়।
২০১৭ সালে বিলটি প্রথমবারের মতো ভোটে তোলা হয়। ৫৫ জন পক্ষে, ৪৮ জন বিপক্ষে ভোট দেন। প্রস্তাবে বলা হয়, রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত মাইক ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকবে। যদিও আন্তর্জাতিক চাপ ও সমালোচনার মুখে তা স্থগিত করা হয়।
‘শব্দদূষণ রোধে’র নামে ইসলামবিরোধী অভিযান
বিজ্ঞাপন
আইন পাস না হলেও ‘শব্দদূষণ’ রোধের অজুহাতে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ আজান বাধাগ্রস্ত করার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
জেরুজালেমের সাবেক মেয়র নীর বারকাত এই অভিযানের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। যেসব মসজিদ বসতি এলাকায় অবস্থিত, তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। তার উত্তরসূরি মেয়র মোশে লিওন ২০১৯ সালে পুরনো স্পিকার বদলে ছোট আকারের ডিজিটাল স্পিকার বসানোর নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
বিজ্ঞাপন
সব মসজিদের আজান ডিজিটালি নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০২৩ সালে শহরের বাজেটে প্রায় ২ লক্ষ ৪১ হাজার ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়। নিয়ন্ত্রণ ডিভাইসগুলো স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে থাকবে।
এদিকে উপ-মেয়র আরিয়ে কিং ইহুদি বসতির পাশে থাকা মসজিদগুলোর মাইনারে লালচিহ্ন টেনে ‘নীরব’ করার দাবিতে প্রচারণা চালান।
শুধু আজান নয়, ইমাম ও খতিবরাও টার্গেট
বিজ্ঞাপন
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধে পর থেকে ইসরায়েলি দমননীতি আরও কঠোর হয়। জেরুজালেমের বহু খতিব ও ইমামকে শুধু গাজার পক্ষে দোয়া করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
‘উসকানিমূলক বক্তব্য’ দেওয়ার অভিযোগে গাজার সুর বাহির এলাকার ইমাম ইসাম আমিরা এবং আইসাওয়িয়ার খতিব জামাল মোস্তফা, এই দুইজন এখনো তিন বছরের সাজা ভোগ করছেন। সম্প্রতি আল আকসার খতিবের ওপরও ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ।
আল-আকসা মসজিদেও বহু খতিবকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে আটক করা হয় এবং পরবর্তীতে পবিত্র স্থান থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিজ্ঞাপন
‘আজান মুছে ফেলা মানে পরিচয় মুছে ফেলা’
জেরুজালেমভিত্তিক আইনজীবী খালেদ জাবারকা আল জাজিরাকে বলেন, ‘আজান শুধু ইবাদতের আহ্বান নয়, এটি আমাদের ধর্মীয় ও জাতীয় পরিচয়ের অংশ। ইসরায়েল এই পরিচয় মুছে ফেলতে চায়।’
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও বলেন, ‘মসজিদে হস্তক্ষেপ ও ইমামদের হয়রানি মানে স্থিতাবস্থার পরিবর্তন। এটি ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা— ইসলামি পরিচয়ের ওপর সরাসরি আঘাত।’
জাবারকার মতে, মুয়াজ্জিনদের ওপর আরোপিত জরিমানা সম্পূর্ণ বেআইনি, কারণ এটি কোনো বৈধ আইনি কাঠামোর আওতায় পড়ে না। ‘বর্তমান পরিস্থিতি আইনবহির্ভূত বিশৃঙ্খলার অংশ।এখানে নৈতিকতা ও মানবাধিকারের কোনো স্থান নেই,’ বলেন তিনি।
তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘আজানের শব্দকে ‘শব্দদূষণ’ আখ্যা দেওয়া মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে সরাসরি আঘাত। মসজিদে প্রবেশ করে নামাজরত কাউকে হেনস্থা করা শুধু আইনি নয়, ধর্মীয়ভাবেও চরম অবমাননাকর। এই কর্মকাণ্ডের ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে।’
বিজ্ঞাপন
এই প্রতিবেদন প্রমাণ করে ইসরায়েল জেরুজালেমে শুধু ভূমি নয়,মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয়, ইবাদতের স্বাধীনতা ও আজানের সুর পর্যন্ত ব্যাহত করার চেষ্টা করছে। সূত্র: আল জাজিরা