Logo

ডিপিডিসি’র এমডি নিয়োগে যোগ্যতা উপেক্ষা

profile picture
বশির হোসেন খান
২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১৬:০৫
36Shares
ডিপিডিসি’র এমডি নিয়োগে যোগ্যতা উপেক্ষা
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) পদের নিয়োগে ইডটকো বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালক (প্রকৌশল) ‘সাব্বির’ উদ্দিন আহমেদের নামে একজন প্রার্থীর নাম তালিকাভুক্ত হওয়ার বিষয়টি নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার শর্ত ভঙ্গ করে কেন এই প্রার্থীকে বাছাই পর্বে রাখা হয়েছে, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।

বিজ্ঞাপন

ডিপিডিসির ২৩ জুলাইয়ের বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এমডি পদের জন্য প্রার্থীর ন্যূনতম ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, যার অন্তত ৩ বছর সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ে বিদ্যুৎ খাতে কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তাছাড়া, অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট অনুমোদিত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যাচাইযোগ্য হতে হবে।

কিন্তু ‘সাব্বির’ নামে আলোচিত প্রার্থীর অভিজ্ঞতা সীমাবদ্ধ একটি কানাডিয়ান বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যালায়েন্স পাওয়ার লিমিটেডের, যা ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং বিদ্যুৎ বিতরণ বা গ্রিড ম্যানেজমেন্টের কাজ করে না। তার ২০ বছরের অভিজ্ঞতা নেই এবং নেই বিদ্যুৎ খাতে অন্তত তিন বছর সিনিয়র ম্যানেজমেন্টে কাজের রেকর্ডও। এ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল- প্রার্থীকে অবশ্যই সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ২০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এর মধ্যে অন্তত ৩ বছর থাকতে হবে পাওয়ার সেক্টরে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট পদে, অর্থাৎ জাতীয় বেতন স্কেলের গ্রেড–৪ বা তার তদূর্ধ্ব পদে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আলোচনায় থাকা প্রার্থী (প্রকৌশলী) সাব্বির উদ্দিন আহমেদ কি সত্যিই এই যোগ্যতা পূরণ করেছেন? যদি তাঁর ২০ বছরের অভিজ্ঞতা সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে অর্জিত না হয়, কিংবা পাওয়ার সেক্টরে অন্তত ৩ বছরের সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট অভিজ্ঞতার প্রমাণ না থাকে, তবে তাঁর নিয়োগ কেবল বিতর্কিতই নয়, বরং বিজ্ঞপ্তির শর্ত লঙ্ঘন হিসেবে আইনত অকার্যকর হবে। প্রার্থীর অভিজ্ঞতার সনদ অনুমোদিত কর্তৃপক্ষ দ্বারা ভেরিফায়েড হতে হবে। বিদ্যুৎ খাতের বাজার, রেগুলেটরি কাঠামো এবং টেকনিক্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট বিষয়ে প্রার্থীর পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। এছাড়া বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, যোগ্য প্রার্থীদের মধ্য থেকে বাছাই করে বোর্ডে পাঠানো হবে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কার স্বার্থে ‘সাব্বির’কে এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে? অনুসন্ধানী সূত্র বলছে, এটি কোনও স্বতন্ত্র নিয়োগ নয়; বরং এক শক্তিশালী বিদেশি লবির প্রভাব ও স্বজনপ্রীতির ফসল হতে পারে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ বিভাগের গোপন সূত্র জানায়, ‘সাব্বিরের পেছনে যে মহলের লবি রয়েছে, তারা পদটির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে মরিয়া।

বিজ্ঞাপন

বিদ্যুৎ খাতের এক অভিজ্ঞ কর্মকর্তা জানান, “এই নিয়োগে পেশাগত যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব বেশি কাজ করছে। ‘সাব্বির’ এর মতো অযোগ্য প্রার্থীদের পেছনে শক্ত লবি ও স্বার্থের সংঘর্ষ রয়েছে, যা দেশের বিদ্যুৎ সেবায় বিরূপ প্রভাব ফেলবে।” অন্যদিকে, দেশে অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলী রয়েছেন যাদের দীর্ঘদিনের সেবা ও অবদান থাকা সত্ত্বেও এই পদে সুযোগ পাচ্ছেন না। তারা এই নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ‘বিদেশি স্বার্থ ও স্বজনপ্রীতির মেলা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ পরিস্থিতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দাবিতে সামাজিক সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন সরব হতে শুরু করেছেন। দেশের বিদ্যুৎ খাতের শীর্ষ পদে বিদেশি লবির ছায়ায় অযোগ্য ব্যক্তির নিয়োগ দেশের সার্বভৌমত্ব ও সেবার মানকে ধ্বংস করতে পারে বলে মনে করে বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞরা।

ডিপিডিসি সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির সরকারি সফরে দেশের বাইরে রয়েছেন। তিনি দেশে ফিরলেই ডিপিডিসির নিয়োগ কমিটির ফলাফল বোর্ডের সুপারিশ নিয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা একজনের নিয়োগ চূড়ান্ত করবেন। ডিপিডিসির এমডি নিয়োগ কমিটির এক সূত্র জানায়, পরীক্ষাটি নেয়া হয়েছে নামকাওয়াস্তে। রাজধানীর এই বড় বিদ্যুৎ বিতরণী কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ।

সূত্রের দাবি, এই পদে একজন ‘বিশেষ ব্যক্তি সাব্বিরকে’ নিয়োগের জন্য আগেই মৌখিক সুপারিশ করা হয়েছিল। ওই প্রার্থীই নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

ডিপিডিসি সূত্র জানায়, প্রথমে আবেদন জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল গত ২২ আগস্ট। পরবর্তীতে ২১ আগস্ট নতুন নোটিশ দিয়ে সময়সীমা বাড়িয়ে ৫ সেপ্টেম্বর করা হয়। তবে নতুন নোটিশে স্পষ্টভাবে বলা হয়। বাকি শর্ত অপরিবর্তিত থাকবে। তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের মধ্যে একজনের অভিজ্ঞতা সীমাবদ্ধ কানাডার একটি ছোট বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যালায়েন্স পাওয়ার লিমিটেডের কাজ করার মধ্যে।

কোম্পানিটি ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল কাজ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশন ও ইন্সট্রুমেন্টেশন সেবা দেওয়া। প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যুৎ বিতরণ বা জাতীয় গ্রিড ব্যবস্থাপনায় কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। সংশ্লিষ্ট প্রার্থীরও ২০ বছরের অভিজ্ঞতা পূর্ণ হয়নি। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতের সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ের অভিজ্ঞতা থাকার যে বাধ্যবাধকতা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ ছিল, সেটিও অনুপস্থিত।

এসব বিষয়ে জানতে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অ্যাডমিন ও এইচ আর) ও নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব সোনা মনি চাকমাকে মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে তিনি রিসিপ করেননি।

বিজ্ঞাপন

ডিপিডিসির সাধারণ প্রকৌশলীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ডিস্ট্রিবিউশন কাজে অভিজ্ঞতা নেই এমন লোকও এমডি পদের জন্য আবেদন করেছেন। শুনেছি, তাদের মধ্য থেকেই একজনকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। প্রকৌশলীরা বলেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের মানদ- সংশোধন না হওয়ায় আমাদের অনেক যোগ্য প্রকৌশলী আবেদনই করতে পারেননি। চাকরিজীবনের পুরোটা সময় মেধা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে তবে তাঁরা কী পেলেন?

বাংলাদেশ পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের একাধিক সদস্য জানান, ডিপিডিসির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার এমডি হতে হলে খাঁটি বিদ্যুৎ বিতরণ খাতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা অপরিহার্য।

তাঁরা বলেন, বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির এমডি মানে শুধু প্রশাসনিক পদ নয়। এখানে লোড-ম্যানেজমেন্ট, গ্রাহকসেবা, প্রযুক্তি, রেগুলেটরি কাঠামো। সব কিছুর বাস্তব অভিজ্ঞতা জরুরি। বিজ্ঞপ্তির শর্তগুলো সেজন্যই দেওয়া হয়েছিল। অযোগ্য কাউকে তালিকায় রাখা হলে নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে।

বিজ্ঞাপন

ডিপিডিসির ভেতরের কিছু কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শর্ত ভেঙে প্রার্থী তালিকায় আসার পেছনে তদবির ও বিশেষ প্রভাব থাকতে পারে।

এক কর্মকর্তা বলেন, আবেদনের প্রাথমিক যাচাইয়ের সময়ই বোর্ডের উচিত ছিল শর্ত পূরণ না হওয়ায় ওই প্রার্থীকে বাদ দেওয়া। তা না করে তালিকায় রাখা হয়েছে। এতে মনে হচ্ছে বাইরে থেকে চাপ ছিল।

বিদ্যুৎ খাতের ভোক্তা সংগঠনের কয়েকজন প্রতিনিধি বলেন, এমডি পদে অভিজ্ঞতাহীন কাউকে বসানো হলে সরাসরি গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

বিজ্ঞাপন

একজন প্রতিনিধি বলেন, ডিপিডিসির আওতায় কয়েক কোটি মানুষ বিদ্যুৎ সেবা পায়। এখানে যদি অভিজ্ঞতাহীন কাউকে বসানো হয়, তাহলে লোডশেডিং, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও গ্রাহকসেবায় বড় সংকট দেখা দেবে।

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে শর্ত বাধ্যতামূলক। কোনো প্রার্থী যদি ওই শর্ত পূরণ না করেও তালিকায় আসেন, তা হলে সেটি আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি কোনো সংস্থা যদি নিজের বিজ্ঞপ্তির শর্ত ভঙ্গ করে, তাহলে সেটি শুধু নৈতিক নয়, বরং আইনগতভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

বিজ্ঞাপন

এই বিষয়ে ডিপিডিসির কোনো অফিসিয়াল বক্তব্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে সংস্থার ক্যারিয়ার পেজে বিজ্ঞপ্তি, নোটিশ ও আবেদনকারীদের জন্য নির্দেশনা প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে শর্তাবলী এখনো অপরিবর্তিত আছে।

ডিপিডিসি অতীতে নিয়োগ, প্রকল্প বাস্তবায়ন, বিল প্রদানে অনিয়মসহ নানা কারণে সমালোচিত হয়েছে। এমডি নিয়োগে নতুন করে শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ আসায় প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা আবারও প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

এ বিষয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির বলেন, আমি সবসময়ই বস্তুনিষ্ঠ অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই।

বিজ্ঞাপন

জেবি/আরএক্স
Logo

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ

মোঃ শফিকুল ইসলাম ( শফিক )

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ৫৭, ময়মনসিংহ লেন, ২০ লিংক রোড, বাংলামটর, ঢাকা-১০০০।

ফোনঃ 02-44615293

ই-মেইলঃ dailyjanobaninews@gmail.com; dailyjanobaniad@gmail.com

জনবাণী এর সকল স্বত্ব সংরক্ষিত। কপিরাইট © ২০২৫

Developed by: AB Infotech LTD