প্রকৌশলী মতিনের টাকায় ভাসছে লুটপাটের নৌকা

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)-এর একটি মেগা প্রকল্পের আড়ালে গড়ে উঠেছে দুর্নীতির এক সুপরিকল্পিত সিন্ডিকেট। আর এই সিন্ডিকেটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো. আব্দুল মতিন।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগ সূত্র বলছে, সরকারি পদ ও প্রভাব কাজে লাগিয়ে প্রকৌশলী মতিন গড়ে তুলেছেন একাধিক ঠিকাদারি লাইসেন্সধারী সিন্ডিকেট, যার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এখন সেই অভিযোগের অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুদক। জানা গেছে, ২০১৮ সালে শুরু হওয়া বিআইডব্লিউটিএর এই প্রকল্পের আওতায় ৩৫টি ড্রেজার, ১৬১টি জলযান, ৩টি ড্রেজার বেইজ এবং ১টি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট নির্মাণের কথা ছিল। প্রকল্পের মোট বরাদ্দ ৪ হাজার ৫১৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। লক্ষ্য ছিল দেশের নদীগুলোতে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা এবং নৌ-যোগাযোগ উন্নত করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো সাত বছরে এই প্রকল্পের অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। বরং একের পর এক বাজেট বৃদ্ধি, সময় বাড়ানো, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রকল্পটিকে এখন জনমনে “লুটপাটের প্রতীক” হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে। মো. আব্দুল মতিন দীর্ঘদিন ধরে বিআইডব্লিউটিএ-র ড্রেজিং বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। তবে অভিযোগ উঠেছে, তিনি কেবল একজন প্রকৌশলী নন বরং প্রকল্পের আড়ালে গড়ে তুলেছেন একটি দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার সিন্ডিকেট।
তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা রীতিমতো চাঞ্চল্যকর, ভুয়া বিল ও ভাউচার তৈরি করে কোটি টাকা আত্মসাৎ, নিজের পছন্দের ঠিকাদারদের দিয়ে কাজ ভাগ করে দেওয়া, আত্মীয়দের নামে ঠিকাদারি লাইসেন্স চালু করে কাজ ভাগাভাগি, যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই বিল উত্তোলন, প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখা, কাজ না করেই বিল পরিশোধ করার অভিযোগ মতিনের বিরুদ্ধে। সূত্র জানায়, প্রকৌশলী মতিন নিয়মিত ঠিকাদারদের কাছ থেকে “বেকডেট কমিশন” নেন। এমনকি ঠিকাদার বাছাই থেকে শুরু করে বিল অনুমোদন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে তার প্রভাব স্পষ্ট। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, মতিনের স্ত্রী, ভাই এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের নামে একাধিক ঠিকাদারি লাইসেন্স রয়েছে। এদের মাধ্যমে বিআইডব্লিউটিএর বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, যা সরকারি নীতিমালার প্রকাশ্য লঙ্ঘন। অর্থাৎ তিনি একদিকে সরকারি প্রকৌশলী, অন্যদিকে গোপনে প্রকল্পের অংশীদার ঠিকাদার, এই দ্বৈত ভূমিকা নিয়েই বছরের পর বছর দুর্নীতির মহোৎসব চালিয়ে গেছেন।
দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের সহকারী পরিচালক রাকিবুল হায়াত এর নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান টিম ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছে। গত বছরের ২৬ নভেম্বর বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে প্রকল্পের দরপত্র, মূল্যায়ন প্রতিবেদন, চুক্তিপত্র, বিল-ভাউচারসহ যাবতীয় নথি চাওয়া হয়। দুদক জানিয়েছে, এসব নথিপত্র যাচাই করে অপরাধ প্রমাণিত হলে মামলার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। সরকারি মনিটরিং সংস্থা আইএমইডি-এর সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে যেসব যন্ত্রপাতি, ড্রেজার বা জলযানের কথা কাগজে উল্লেখ আছে, সেগুলোর বাস্তব কোনো অস্তিত্বই নেই মাঠ পর্যায়ে।
বিজ্ঞাপন
এমনকি প্রকল্পের মান নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির দায়িত্বও অর্পণ করা হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একজন ছাত্রের ওপর! সরকারি এই বিশাল প্রকল্প তদারকিতে কোনো প্রকৌশলী বা পরামর্শক উপস্থিত নেই, এ তথ্য একে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল মতিনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এসএমএস পাঠানো হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী বলেন,“ড্রেজার প্রকল্পের আড়ালে চলা এই লুটপাট যেন জাতির জন্য সতর্কবার্তা। ব্যক্তিগত লোভ ও প্রভাব কীভাবে জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করে দেয়, মতিন তার জলজ উদাহরণ।” তিনি আরও বলেন, “এই চক্রের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্নীতির জন্ম হবে।”
বিজ্ঞাপন