প্রকৌশলী মতিনের ঠিকাদারি সাম্রাজ্য

সরকারি প্রকল্পের অর্থে উন্নয়ন নয়, হয়েছে লুটপাট। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ড্রেজার ও জলযান সংগ্রহ প্রকল্প যেন হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত আখের গোছানোর মঞ্চ।
বিজ্ঞাপন
আর এই মঞ্চের প্রধান চরিত্র নির্বাহী প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো. আব্দুল মতিন। নিজের নামে না চালিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আড়ালে কাজ ভাগিয়ে নিয়ে বছরের পর বছর ধরে সরকারি অর্থ লোপাট করে আসছেন এই প্রকৌশলী। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর সহকারী পরিচালক রাকিবুল হায়াত অভিযোগ অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দুদক ইতোমধ্যে মতিন, তার স্ত্রী শাহানা আক্তার জলি ও দুই সন্তানের সম্পদের তথ্য জানতে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, রাজউক, ভূমি অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস, এনবিআরসহ বিভিন্ন সংস্থায় চিঠি পাঠিয়েছে। ১৮ জুনের মধ্যে এসব তথ্য জমা দিতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, আব্দুল মতিন নিজে সরাসরি কোনো কাজ না করলেও, তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, স্ত্রী, ভাই, এমনকি বন্ধুবান্ধবদের নামে কমপক্ষে ৭টি ঠিকাদারি ফার্ম সক্রিয়ভাবে বিআইডব্লিউটিএর বিভিন্ন কাজ পেয়ে এসেছে। নানা কৌশলে কাজ পেতেন মতিনের নির্দেষ্ট ফার্ম গুলো। কৌশল গুলো হলো- দরপত্র আহ্বান হলে মতিনের নির্দেশে নির্দিষ্ট ফার্মগুলো টেন্ডারে অংশ নেয়। দরপত্র মূল্যায়নে মতিন নিজেই ছিলেন ‘পরামর্শদাতা’। কম দামে প্রাক্কলন দেখিয়ে পরে বাড়তি বিল অনুমোদন করা হতো। বাকি ফার্মগুলোকে নানা কৌশলে বাদ দেওয়া হতো।
অপরদিকে জালিয়াতির মাস্টার প্রকৌশলী মতিন ভুয়া মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকৃত কাজ না করে অনুমোদনের জন্য বানানো হত সাজানো কাগজপত্র। জমা দেওয়া বিলের সঙ্গে কাজের মিল নেই নিরীক্ষায় ধরা পড়ে, যেখানে শতভাগ বিল দেওয়া হয়েছে, সেখানে কাজ হয়েছে ৪০ভাগের নিচে। মাঠে যন্ত্রপাতি নেই সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, তালিকাভুক্ত ড্রেজার বা যন্ত্রপাতি বাস্তবে উপস্থিত নেই। বিল উত্তোলন হয়েছে, এলসি হয়নি অর্থাৎ, প্রকল্পের নামে টাকা ছাড় হলেও বাস্তব কোনো ক্রয় হয়নি।
বিজ্ঞাপন
দুদক ২০২৪ সালের শেষভাগে আনুষ্ঠানিকভাবে মতিনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। ইতিমধ্যে ৬১টি দরপত্র প্যাকেজের মধ্যে ৩৪টির বিষয়ে তদন্ত চলছে, প্রাথমিকভাবে ২০০ কোটির বেশি অর্থ লোপাটের প্রমাণ মিলেছে। প্রকল্পের আর্থিক কাগজপত্র, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, ব্যক্তিগত সম্পদের হিসাব যাচাই করা হচ্ছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা জানায়, অভিযোগের সত্যতা পেলে দ্রুত মামলা দায়ের করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রকৌশলী বলেন, সরকারি কর্মকর্তার কোনো রকম বাণিজ্যিক সংশ্লিষ্টতা রাখার নিয়ম নেই। কিন্তু মতিন নিজের প্রভাব খাটিয়ে একের পর এক কাজ নিজেই ভাগ করে নিয়েছেন। সরকারি প্রকল্পে এমন ভূমিকা বহুবিধ দুর্নীতির শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বিজ্ঞাপন
আইএমইডি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পে গুণগত মান যাচাই হয়নি, সময়মতো সরবরাহ হয়নি, বরং অর্থপ্রবাহ ছিল সবচেয়ে বেশি। এটি দুর্নীতির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাবেক প্রকৌশলী বলেন মতিন শুধু ব্যক্তি নন, সে একটা সিস্টেম। তাকে ধরলে গোটা চক্র উন্মোচিত হবে। প্রকৌশলী আব্দুল মতিনকে অবিলম্বে সাময়িক বরখাস্ত করে জিজ্ঞাসাবাদে করা দাবি জানান এই প্রকৌশলী। প্রকৌশলী মতিনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট শুধুই ব্যক্তি-ভিত্তিক নয়, এটা সিস্টেমের ভেতরে তৈরি হওয়া মাফিয়া স্টাইল দুর্নীতির চিত্র।