রাজধানীর আকাশজুড়ে ‘কালো জঞ্জাল’ ঝুঁকিতে নগরবাসী

রাজধানী ঢাকা আজ এক অদ্ভুত জটিলতার শহর। সড়কে যানজট, ফুটপাতে দখল, আর আকাশজুড়ে কালো তারের জঞ্জাল।
বিজ্ঞাপন
মহাখালী, মিরপুর, উত্তরা কিংবা বাড্ডা কোনো এলাকাই এই তারের বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত নয়। বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও ইন্টারনেটের খুঁটিতে জটলা পাকানো অসংখ্য তার শুধু সৌন্দর্যহানি ঘটাচ্ছে না, বরং দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কোথাও কোথাও এসব তার মানুষের কাঁধ কিংবা কোমর সমান উচ্চতায় ঝুলে আছে, যা পথচারীদের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনছে।
বাড্ডা ও নদ্দা এলাকার ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে গেলে মাথার ওপরে নেমে আসা তার সরিয়ে চলতে হয়।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয়দের অভিযোগ, অপারেটররা নতুন সংযোগ দেওয়ার সময় পুরোনো অকার্যকর তারগুলো সরায় না, ফলে প্রতিটি খুঁটিই পরিণত হচ্ছে তারের স্তূপে। উত্তরা, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর এলাকা সর্বত্র একই চিত্র। উত্তরার কিছু খুঁটিতে একসঙ্গে ২৫টিরও বেশি তার ঝুলতে দেখা যায়।
স্থানীয় দোকানি হাফিজুল্লাহ বলেন, “প্রায়ই দেখি কেউ এসে তারগুলো গুছিয়ে দেয়, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই আবার নিচে নেমে আসে। অনেক সময় ছেঁড়া তার রাস্তায় পড়ে থাকে, যা ছোট বাচ্চা বা বয়স্কদের জন্য বিপজ্জনক।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সোহেল আহমেদ বলেন, “রাতে গলির মুখে ফেরার সময় কয়েকবার ঝুলন্ত তারে আটকে গেছি। এটি ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ।”
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে, সরকারি সংস্থার হঠাৎ অভিযানেই নতুন সমস্যা তৈরি হয়। কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই ঝুলন্ত তার কেটে দেওয়ার ফলে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট, টেলিভিশন ও ফোন সংযোগ। এতে সাধারণ মানুষ, অফিস, স্কুল-কলেজ এমনকি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বিপাকে পড়ে।
বাংলানেট টেকনোলজিস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী জুবায়ের আলমাহমুদ হোসাইন জানান, “প্রত্যেক অপারেটর আলাদা ফাইবার টেনে সেবা দেয়। ফলে একই এলাকায় একাধিক প্রতিষ্ঠান ক্যাবল ঝুলিয়ে রাখে, যা অপ্রয়োজনীয় জঞ্জাল তৈরি করছে। ক্যাবল শেয়ারিং চালু হলে একই অবকাঠামো ব্যবহার করে একাধিক অপারেটর কাজ করতে পারবে, এতে খরচ কমবে ও সৌন্দর্য বজায় থাকবে।”
বিজ্ঞাপন
আইএসপিএবি সভাপতি মোহাম্মদ আমিনুল হাকিম বলেন, “ঢাকায় ঝুলন্ত তার সমস্যার স্থায়ী সমাধান হলো ‘অ্যাকটিভ শেয়ারিং’। এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে প্রতিটি ভবনে একটি মাত্র ফাইবার থাকবে, যেটি সব অপারেটর ব্যবহার করতে পারবে। এতে ৬০ শতাংশের বেশি তার সরানো সম্ভব হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ওয়্যারলেস প্রযুক্তি দিয়ে উচ্চ ব্যান্ডউইথ অ্যাপ্লিকেশন চালানো যায় না। ভিডিও স্ট্রিমিং, ক্লাউড সার্ভিস এসবের জন্য ফাইবারই অপরিহার্য। তাই তার সম্পূর্ণ তুলে ফেলা সম্ভব নয়, বরং নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা দরকার।”
বিজ্ঞাপন
বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শফিউল আজম পারভেজ জানিয়েছেন, সরকার নতুন লাইসেন্সিং নীতি অনুমোদন করেছে, যার আওতায় “নেটওয়ার্ক শেয়ারিং” উন্মুক্ত করা হবে।
তিনি বলেন, “সব সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই জঞ্জাল দূর করা সম্ভব নয়। সিটি করপোরেশন, বিদ্যুৎ বিভাগ ও রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা ও পরিকল্পনার অভাবে রাজধানীর আকাশজুড়ে তৈরি হয়েছে এই ‘কালো জঞ্জাল’। এখন সময় এসেছে হঠাৎ অভিযান নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি নীতিনির্ভর উদ্যোগ নেওয়ার। যাতে ঢাকার আকাশও একদিন তারের বোঝা থেকে মুক্ত হয়।