ডিপিডিসি’র এমডি নিয়োগে প্রতারণা

রাজধানী বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে ইডটকো বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালক (প্রকৌশল) ‘সাব্বির’ উদ্দিন আহমেদের নিয়োগ নিয়ে দেখা দিয়েছে তীব্র বিতর্ক ও প্রশ্ন।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগ উঠেছে, এক প্রার্থী ভুয়া বা যাচাইযোগ্য নয় এমন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ অনেকটা চূড়ান্ত। যা সরাসরি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত লঙ্ঘন করে।
নিয়োগ শর্ত: ডিপিডিসি কর্তৃক প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল“প্রার্থীকে কমপক্ষে ২০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, যার মধ্যে অন্তত ৩ বছর থাকতে হবে পাওয়ার সেক্টরের সিনিয়র ম্যানেজমেন্টে।”এখানে “পাওয়ার সেক্টর” বলতে বোঝানো হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন বা বিতরণ সংক্রান্ত স্বীকৃত ইউটিলিটি বা কর্তৃপক্ষ।
অ্যালায়েন্স পাওয়ার কি আদৌ বিদ্যুৎখাতের প্রতিষ্ঠান: ডিপিডিসির এমডি পদে আবেদনকারী ‘সাব্বির’ উদ্দিন আহমেদ তাঁর সিভিতে উল্লেখ করেছেন, তিনি কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘অ্যালায়েন্স পাওয়ার লিমিটেডের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেটিকে তিনি “পাওয়ার সেক্টরের সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট অভিজ্ঞতা” হিসেবে দাবি করেছেন।
বিজ্ঞাপন
অনুসন্ধানে উঠে আসে চমকপ্রদ তথ্য: অ্যালায়েন্স পাওয়ার লিমিটেডের একটি ওয়েবসাইট (alliancepower.ca) থাকলেও সেখানে কোনো প্রকল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন সংক্রান্ত তথ্য, কিংবা অর্থনৈতিক প্রতিবেদন নেই। কানাডার SEDAR+ বা সরকারি ব্যবসায়িক ডাটাবেসেও কোম্পানিটির নিবন্ধিত কোনো রেকর্ড নেই। কোম্পানির প্রকৃত অফিস, কর্মী, কিংবা চলমান প্রকল্প সম্পর্কেও কোনো প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। কানাডার যে ঠিকানায় চাকরি করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন সেই স্থানে ‘অ্যালায়েন্স পাওয়ার’ এর কোনো অস্থিত মেলেনি। এর কোনো বৈধ নথি বা সাম্প্রতিক ফাইলিং নেই। ফোন নম্বর সব সময় ভয়েস মেইলে চলে যাচ্ছে, কোনো রিসেপশন বা কর্মরত স্টাফের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে ইউনিট #১০২, ৮০৪৭ ১৯৯ স্ট্রিট, ল্যাংলি, বিসি ২০২৫ থেকে বিক্রয়ের জন্য সাইন বোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১,৪৪৪ স্কয়ার ফিট যার মূল্য ধরা হয়েছে কানাডিয়ান ডলার ১,৩৭১,০০০। বাড়িটি ৮৯ মাস ধরে এটি খালি পড়ে আছে। ওই ঠিকানায় অ্যালায়েন্স পাওয়ারের অফিস ছিলো না। অনেক বছর ধরেই ওই ঠিকানায় বিভিন্ন কোম্পানীর শ্যাম্পু বিক্রির দোকান আছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একটি ‘শেল কোম্পানি’ কেবল একটি নাম ও ওয়েবসাইটের ভিত্তিতে “সুযোগ তৈরি করা” হয়, কিন্তু বাস্তবে কোনো বিদ্যুৎ প্রকল্প বা কার্যক্রম পরিচালিত হয় না।
বিজ্ঞাপন
বিদ্যুৎখাতের একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘অ্যালায়েন্স পাওয়ার’ কোনো বৈধ ইউটিলিটি নয়। সেখানে কাজ করার অভিজ্ঞতাকে যদি পাওয়ার সেক্টরের অভিজ্ঞতা হিসেবে গণ্য করা হয়, তা হলে এটি সরাসরি প্রতারণা ও অযোগ্য নিয়োগ।” তিনি আরও বলেন, এমডি পদে নিয়োগের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে এমন ভুয়া যোগ্যতা গ্রহণযোগ্য নয়। এটি রাষ্ট্রের বিদ্যুৎখাতের ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ। প্রশ্ন উঠছে, নিয়োগ বোর্ড কীভাবে অ্যালায়েন্স পাওয়ার এর অভিজ্ঞতাকে বৈধ পাওয়ার সেক্টর অভিজ্ঞতা” হিসেবে স্বীকৃতি দিল। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করা হয়েছিল কি? দেশে অসংখ্য যোগ্য, প্রকৃত অভিজ্ঞ প্রকৌশলী থাকার পরেও এমন সন্দেহজনক প্রার্থীকে কেন অগ্রাধিকার দেওয়া হলো? এমডি পদে চূড়ান্ত তালিকায় সাব্বিরের ডিস্ট্রিবিউশন সেক্টরের কোন অভিজ্ঞতাই নাই। যারা যাচাই-বাছাই কমিটিতে যারা ছিলেন তারা কিভাবে তাকে বাছাই করলে বিষয় তদন্ত করে শাস্তির দাবি জানিয়েছেন সিনিয়র প্রকৌশলীরা।
বিশ্লেষক ও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই নিয়োগ নিয়ে স্বতন্ত্র তদন্ত কমিটি গঠন, এবং সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর আসল অভিজ্ঞতা যাচাই এখন সময়ের দাবি। প্রয়োজনে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত রেখে নতুন করে আবেদন আহ্বান করার পরামর্শও দিয়েছেন জ্বালানী বিশ্লেষকরা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক কর্মকর্তা অ্যালায়েন্স পাওয়ার এর মতো একটি অনির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতাকে পাওয়ার সেক্টরের সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট এক্সপেরিয়েন্স হিসেবে গণ্য করাকে ভয়াবহ ও চরম অনিয়ম বলে অভিহিত করেছেন।
বিজ্ঞাপন
এ বিষয় বুয়েট ইইই বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান বলেন, বিদ্যুৎখাতের সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট বলতে বোঝায় এমন অভিজ্ঞতা যেখানে প্রার্থী প্রকৃত বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন বা বিতরণে পরিচালনামূলক বা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ভূমিকা পালন করেছেন। কোনো শেল কোম্পানিতে নামমাত্র কাজ করাকে এ অভিজ্ঞতা বলা একধরনের ধোঁকাবাজি। এতে প্রতিষ্ঠান যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেক্টরের ভবিষ্যত।”
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ এর সাবেক এমডি ইঞ্জিনিয়ার সাদিক উল্লাহ বলেন, কানাডার অ্যালায়েন্স পাওয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে বটে, কিন্তু তাদের ওয়েবসাইট বা সরকারি ডাটাবেসে কোনো প্রকল্পের অস্তিত্ব নেই। সেটি যদি প্রকৃত বিদ্যুৎ কোম্পানি না হয়, তাহলে সেখানে কাজ করাকে পাওয়ার সেক্টরের অভিজ্ঞতা হিসেবে ধরা যায় না। এটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত লঙ্ঘন। এ ধরনের ভুয়া যোগ্যতা গ্রহণযোগ্য নয়।”
এ বিষয় বিদ্যুৎ খাত বিশ্লেষক ও এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার জার্নালের উপদেষ্টা মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, ডিপিডিসির মতো একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে এমডি নিয়োগে যদি অভিজ্ঞতা যাচাই না হয়, তা হলে সেটি শুধুই নিয়োগ নয় এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদের সঙ্গে প্রতারণা। প্রশ্ন হচ্ছে, কে বা কারা এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছে? তদন্ত হলে সত্য বেরিয়ে আসবে। জনগণের জানার অধিকার রয়েছে।”
বিজ্ঞাপন
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এনার্জি গভর্নেন্স রিসার্চার ড. রুবাইয়াৎ আহমেদ বলেন,“এই নিয়োগ যদি সত্যিই ভুয়া অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে হয়, তাহলে এটি ভবিষ্যতে একটা বড় প্রভাব ফেলবে। কারণ নেতৃত্বে ভুল মানে নীতিনির্ধারণে ভুল আর বিদ্যুৎ খাতের ভুল সিদ্ধান্ত পুরো দেশের জন্য ব্যয়বহুল।”