ব্যাট হাতে আলো ছড়াচ্ছে দৃষ্টিহীন ক্রিকেটার ফয়সাল


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮:০৯ অপরাহ্ন, ১৬ই মার্চ ২০২৪


ব্যাট হাতে আলো ছড়াচ্ছে দৃষ্টিহীন ক্রিকেটার ফয়সাল
আরাফাতুল ইসলাম ফয়সাল - ছবি: প্রতিনিধি

চট্টগ্রামের দৃষ্টিহীন এক ক্রিকেটারের নাম আরাফাতুল ইসলাম ফয়সাল। চোখে আলো না থাকলেও আন্তর্জাতিক মহলে দেশকে করেছে আলোকিত। ব্যাট বল হাতে অদম্য যেন তিনি। বাংলাদেশের হয়ে দুই আইবিএসএ ওয়ার্ল্ড গেমসে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেছেন।কিন্তু যে ব্যাট হাতে তিনি বিশ্বমঞ্চ জয় করেছেন, সেই ক্রিকেট ব্যাটের আঘাতেই আরাফাতের চোখের আলো নিভে যায় চিরতরে। 


সম্প্রতি ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত আইবিএসএ ওয়ার্ল্ড গেমস-২০২৩ ক্রিকেট ইভেন্টে, দ্বিতীয় রানার্সআপ হয়ে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করে বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেট দল। এতে আরাফাত মেধা ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে বলের শব্দ বুঝেই ক্রিকেট ব্যাট চালিয়ে মারেন চার-ছক্কাও। 


চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত আরাফাত বর্তমানে অলরাউন্ডার হয়ে খেলছেন বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলে। লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করে দেশের জন্য সুনাম কুড়ানোয় খুশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পরিবার ও ভক্তরা।

সর্বশেষ দেশের হয়ে ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত আইবিএসএ ওয়ার্ল্ড গেমস-২০২৩ খেলেছে বাংলাদেশ দল। যেখানে ছিলেন আরাফাতও।


২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ভারতের মাটিতে প্রথম আর্ন্তজাতিক দ্বিপাক্ষিক সিরিজ দিয়ে অভিষেক হয় অদম্য আরাফাতের। দুই চোখে আলো না থাকলেও নিজেদের প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে ৩২ রানে, দ্বিতীয় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ৫৩ রানে হারিয়ে অ্যালিমেনিটরে উঠে বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেট দল। এর আগে ২০২২ সালে ব্লাইন্ড ক্রিকেট টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপে  বাংলাদেশ রানার্সআপ হয়। সেই টিমেও দলের গুরুত্বপূর্ণ অলরাউন্ডারের ভূমিকা রাখেন আরাফাত।


নিজের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অদম্য আরাফাত। তিনি দৈনিক জনবানীকে বলেন, ব্যাটে বলে শাসন করে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনাই আমার মূল লক্ষ্য।


দৃষ্টিহীন হয়েও কিভাবে ক্রিকেট খেলেন এই প্রশ্নের উত্তরে আরাফাত বলেন, ব্যাটিংটা নরমাল ক্রিকেটের মত, তবে আমাদের বলে বিশেষ একটিশব্দ করে বোলিং করার পর একটি বিশেষ শব্দ হয়, যা শোনে আমরা ব্যাটিং করি। ফিল্ডিংটাও শব্দের ওপর নির্ভর করে করা হয়। এছাড়া বোলিং করার সময় ব্যাটসম্যানের সাথে কথা বলে জিজ্ঞেস করে নেওয়া হয়, ব্যাটসম্যান প্রস্তুত আছে কি না। মূলত কমান্ডের ওপর বোলিংটা করা হয় বলেও জানান তিনি।

সম্প্রতি আইবিএসএ ওয়ার্ল্ড গেমস-২০২৩ দলের ব্রোঞ্জ পদক অর্জন প্রসঙ্গে এই ক্রিকেটার বলেন- আলহাম্‌দুলিল্লাহ, আমরা আমাদের প্রত্যাশামাফিক এবারের লক্ষ্যটা অর্জন করতে পেরেছি। প্রথমবার হিসেবে কন্ডিশন বিবেচনায় আমাদের টার্গেটটাই ছিল ব্রোঞ্জ। সেটা এবার আমরা অর্জন করেছি। আগামীতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার টার্গেট রাখি। এখানে প্রথম ম্যাচ ইংল্যান্ডের সাথে, দ্বিতীয় ম্যাচ পাকিস্তানের সাথে, তৃতীয় ম্যাচ ইন্ডিয়ার সাথে, চতুর্থ ম্যাচ অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলেছি। যেখানে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে বড় ব্যবধানে হারিয়েছি। ভারতের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে দুভাগ্যজনকভাবে ৩ উইকেটে হেরে যাই।


তিনি এই ইভেন্ট নিয়ে আরও বলেন, এবারের আইবিএস ওয়ার্ল্ড গেমসে বিভিন্ন ইভেন্টে ওয়ার্ল্ডের ৭০টি দেশ অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে আমরা বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরেছি বহির্বিশ্বে। ব্রোঞ্জ পদক পেয়ে বাংলাদেশের সুনাম বাড়িয়েছি।


বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলের আগামীর পরিকল্পনা কী, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে আগামীতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের মাটিতে ব্লাইন্ড ক্রিকেট টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপে চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। তারই অংশ হিসাবে আমরা খেলোয়াড়রা কঠোর অনুশীলন করতে ঐক্যবদ্ধ।

এ সময় তিনি বলেন, সফলতা পেতে হলে তো স্ট্রাগলের কোনো বিকল্প নেই। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় আমার চোখে বল পড়ে চোখের রেটিনা ফেটে গিয়েছে। এরপর থেকে আমি ব্লাইন্ড ক্রিকেটে খেলে যাচ্ছি। সর্বোপরি পরিশ্রমের বিকল্প আর কোনো কিছু হতে পারে না বিশেষ করে স্পোর্টসে।


প্রসঙ্গত, ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা নিয়ে আরাফাতের ছিল অদম্য অনুরাগ ;বিশেষত ক্রিকেট। কিন্তু ,স্রষ্টার ইচ্ছায় এই ক্রিকেট-ই কেড়ে নেয় তার দৃষ্টিশক্তি। ২০১১ সালের ২৮ মে ফটিকছড়ির জাফতনগর লতিফ রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার সময় দ্রুতগতির বল এসে চোখে লাগলে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার দুই চোখের রেটিনা। ভারতসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক চিকিৎসা নিয়েও চোখে দেখতে কষ্ট হয় তার। এক পর্যায়ে ধীরে ধীরে নিভে যায় তার বাম চোখের দৃষ্টিশক্তি। ডান চোখে কিছুদিন দেখতে পেলেও সেটিরও আলোকশক্তি কমে যায়। যদিও ভারতের ডাক্তারেরা কৃত্রিম রেটিনা প্রতিস্থাপনের ব্যাপারে কিছুটা আশাবাদী করেছিল। ভারতে গিয়ে আরাফাতের পরিবার জানতে পেরেছিল ,দেশে এতদিন তার ভুল চিকিৎসা হয়েছে।ফলে ধীরে ধীরে আরাফাতের সকল সপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিনত হয়। 


আরাফাতের বাবা মাওলানা নজরুল ইসলাম দৈনিক জনবানীকে বলেন- আলহাম্‌দুলিল্লাহ, আমার ছেলের পারফরমেন্সে আমি খুশি। আমি একসময় প্রবাসে (সংযুক্ত আরব) ছিলাম। ছেলে এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে খেলে জয় ছিনিয়ে আনছে, তাতে আমি আনন্দিত। আশা করব আমার ছেলে ক্রিকেটে আরও ভালো করবে এবং বিশ্বজয় করবে। ইতোমধ্যে আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা সফলভাবে শেষ করার আশাও রাখেন তিনি।এ সময় তিনি দৈনিক জনবানীর মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশবাসীর কাছে আরাফাতের জন্য দোয়া চান। 


আরও পড়ুন: এবার আইপিএলকে ‘সার্কাস’ বললেন মিচেল স্টার্ক


সফলতার এই পর্যায়ে এসে অতীত ঘেটে আরাফাত বলেন, এতসব হাঙ্গামায় আমার পড়াশোনায়ও একটা বেশ বড়সড় ধাক্কা লাগলো। আমাকে নিয়ে মানুষদের অন্যরকম টিপ্পনি কাটা কঠিন দাগ ফেলছিল আমার হৃদয়ে। ভেঙে পরছিলাম খুব দ্রুত। ঘরবন্দী-ই করে ফেলেছিলাম একরকম নিজেকে। কিন্তু সেই সময় আমার পরিবার ও কাছের মানুষগুলো যথেষ্ট মানসিক সাপোর্ট এবং সহযোগিতা করেছে আমাকে। তারা সাহস জুগিয়েছে, শক্তি দিয়েছে ; নতুন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছে। 


২০১২ সালে মুরাদপুরের সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে আবারো ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই আমি। নতুনভাবে শুরু হয় চ্যালেঞ্জিং এক শিক্ষাযাত্রা। আব্দুস সামাদ স্যারের কথা এখানে না বললেই নয়। স্যারের  অনুপ্রেরণা , আশীর্বাদ এবং সেই বিদ্যালয়ের সকল সহপাঠী ও শিক্ষক মহলের অসাধারণ প্রেরণায় পুরোদমে নিজেকে তৈরি করার কাজে তৎপর হই। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়ার পর নবম শ্রেণীতে এসে ভর্তি হই চট্টগ্রামেরই রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চমাধ্যমিক শুরু করি হাজেরা-তাজু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। 


পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাও থেমে থাকে-নি আমার। স্কুলেই জানতে পেরেছিলাম, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্যেও আছে বিশেষ ধরনের ক্রিকেট খেলার ব্যবস্থা। সেই থেকে পুনরায় শুরু করে দেই এই খেলাধুলা যাত্রা। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেট টিমের হয়ে খেলার প্রস্তাব পেয়ে যাই আমি। Chittagong Disable Sporting Club -এর সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করার সুযোগ হয়েছে আমার । 


শুধু ক্রিকেট নয়, বিভিন্ন কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজে অংশগ্রহণের চেষ্টা করেছি আমি। উপস্থিত বক্তৃতা, দাবা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা এমনকি অভিনয় পর্যন্ত করার-ও সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই নি। টেকনোলজিতেও যেন পিছিয়ে না পরি, তাই এই ক্ষেত্রেও পারদর্শিতা অর্জনের যথেষ্ট চেষ্টা করেছি।


আরও পড়ুন: দুই দশক পর পাকিস্তানে হতে যাচ্ছে ত্রিদেশীয় সিরিজ


খুব সহজভাবে বলতে গেলে, আমার জীবনের পথ চলাটা সহজ ছিল না মোটেও। পরিবার, শিক্ষক, সহপাঠী,  সকলের সহযোগিতা,  অসাধারণ কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী এবং সর্বোপরি সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় আমি পেয়েছি নতুন এক জীবন। আলো ছাড়াই সামনের বিস্তীর্ণ পথ পাড়ি দেবার দৃঢ় সংকল্প এঁটেছি মনে মনে। যতদূর আমার দ্বারা যাওয়া সম্ভব , আমার অদম্য চেষ্টা ও পরিশ্রম থামবে না,আশা রাখছি।


তবে, দেশের জন্য বহিঃবিশ্ব থেকে সুনাম কুড়িয়ে আনলেও দেশের সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তর এবং কি কোনো বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকদের কাছ থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো মানবিক সহায়তা পাননি বলে আক্ষেপ জানান ফয়সাল। তিনি বলেন, এই ক্রিড়া অঙ্গনের থেকে প্রাপ্ত নাম মাত্র অর্থে নিজের খরচ মেটাতেও হিমসিম খেতে হয় তাকে। মূলত যাবতীয় খরচ মেটাতে তার পরিবারের দ্বারস্থ হতে হয় বলে হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি।


আরাফাত ২০১৫ সাল থেকে চিটাগাং ব্লাইন্ড ক্রিকেট টিমে খেলে আসছেন। দৃষ্টিহীন হওয়ার পর ২০১২ সালে চট্টগ্রাম নগরীর সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে আরাফাতের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ২০১৯-২০২০ সেশনে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। বর্তমানে চতুর্থ বর্ষে অধ্যায়নরত।


জেবি/এসবি