সেই ওয়ান-ইলেভেন আজ, কী ঘটেছিল সেদিন?


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২:০২ অপরাহ্ন, ১১ই জানুয়ারী ২০২৫


সেই ওয়ান-ইলেভেন আজ, কী ঘটেছিল সেদিন?
ফাইল ছবি

আমেরিকার টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাবহুল সেই নাইন-ইলেভেনের (৯/১১) কথা মনে আছে? সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় মার্কিনদের। তেমনই এক আলোড়িত ঘটনা ওয়ান-ইলেভেন। দেশের রাজনীতির ইতিহাসে বাঁক বদলের বহুল আলোচিত-সমালোচিত সেই ওয়ান-ইলেভেনের আজ ১৮ বছর পূর্তি হলো। জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের এই দিনে (১১ জানুয়ারি) দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।


২০০৭ সালের এদিন বিকেলে জরুরি অবস্থা জারির পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়।


কী ঘটেছিল সেদিন?


দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। বি গুজব ও গুঞ্জনে সার্বিক পরিস্থিতি ছিল থমথমে। এ অবস্থায় বিকেল চারটার দিকে আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফর উল্যাহ ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল কানাডিয়ান হাইকমিশনারের বাসায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে যোগ দেন।


আরও পড়ুন: নিবন্ধিত সব দল নিয়েই আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে: সিইসি


সেই বৈঠকে কূটনীতিকদের মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার ডগলাস ফসকেট, জাপানের রাষ্ট্রদূত ইনোওয়ে মাসাইয়েকি, ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) ডেলিগেশন প্রধান রাষ্ট্রদূত ড. স্টিফান ফ্রোইন ও জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রেনাটা ডেজালিয়েন উপস্থিত ছিলেন।


বিকেল পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত বৈঠক শেষে অনেকটা হতাশ হয়ে বেরিয়ে আসেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তখন আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা সাংবাদিকদের কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান।


পরে সেখান থেকে আওয়ামী লীগ নেতারা সরাসরি চলে যান দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার ধানমন্ডির সুধাসদনের বাসায়।


এদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা বের হওয়ার আধাঘণ্টা পর বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে কানাডিয়ান হাইকমিশনারের বাসায় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল। এর নেতৃত্বে ছিলেন বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। তবে বৈঠক শেষে তারাও মুখ খোলেননি।


সোজা নেতাকর্মীরা চলে যান গুলশানের হাওয়া ভবনে। সেখানে তারা বৈঠক করেন দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে।


আরও পড়ুন: সন্ধান মিলল গণ-অভ্যুত্থানে নিহত অজ্ঞাত ৬ মরদেহের


এর আগে, দুপুর পৌনে বারোটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত জাতীয় পার্টির (জাপা) তৎকালীন চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের সঙ্গে তার বারিধারার বাসায় বৈঠক করেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী।


কূটনীতিকদের সঙ্গে প্রধান দুটি দলের বৈঠকের আগে প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দুপুর বারোটায় বৈঠক করেন আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সঙ্গে। এতে কমিটির সদস্যরা ছাড়াও সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান উপস্থিত ছিলেন।


এই বৈঠকের পরপরই রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন বঙ্গভবনে তিন বাহিনী প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন।


অন্যদিকে, বিকেল সাড়ে চারটায় উপদেষ্টা পরিষদের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল করা হয়। দু-একজন ছাড়া উপদেষ্টাদের প্রায় সবাই বঙ্গভবনে গিয়ে বৈঠক বাতিলের খবরে ফিরে আসেন।


বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিমানবাহিনী প্রধান, নৌবাহিনী প্রধান, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র‍্যাব, বিডিআরসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের নিয়ে সেনা সদরে বৈঠক করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ।


পরে রাত সাড়ে ৮টায় বঙ্গভবনে পুনরায় উপদেষ্টাদের ডাকা হয়। সে সময় উপদেষ্টাদের সবাইকে পদত্যাগের অনুরোধ জানানো হয়। এরপর প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়ান রাষ্ট্রপতি। একই সঙ্গে উপদেষ্টারাও পদত্যাগ করেন।


পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে। তিনি নতুন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন।


আরও পড়ুন: পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশ উপদেষ্টা


এসব নাটকীয় ঘটনা ও টানটান উত্তেজনা-উদ্বেগের মধ্যেই সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বিপন্ন এবং বিপদের সম্মুখীন হওয়ায় রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন।’


এরপর বিভিন্ন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রাত সাড়ে ১১টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ।


ভাষণে তিনি বলেন, একইসঙ্গে দুটি দায়িত্ব নেওয়ার পর আমাকে ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথকে সুগম করতে আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।


এর আগে, ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে তার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।


প্রসঙ্গত, জরুরি অবস্থা জারির পর রাজনৈতিক দলগুলোর সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। শুরু হয় রাজনৈতিক নেতাদের ধরপাকড়। দুর্নীতির অভিযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা মামলায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই গ্রেফতার হন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই তখন গ্রেফতার হন।


আরও পড়ুন: জামিন বাতিল করে সাদপন্থিদের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি


২০০৭ সালের ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে বিশেষ কারাগারে রাখা হয়। একই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়াকেও গ্রেফতার করে বিশেষ কারাগারে নেওয়া হয়। সে সময় দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার গুঞ্জন ওঠে। মাইনাস-টু ফর্মুলা তখন ছিল একটি বহুল আলোচিত বিষয়।


এর প্রেক্ষিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা রাজপথে নেমে আসে। পরিস্থিতি অনুধাবন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এক পর্যায়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে ঘরোয়া রাজনীতিরও অনুমতি দেয়।


এরপর ধীরে ধীরে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারাও মুক্তি পান। প্রায় দুই বছর অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করে।


এমএল/