যে ভূমিকম্প তছনছ করেছিল সিলেট, ৩ দিনে হয়েছিল ২০০ আফটারশক

১৮৯৭ সালের ১২ জুন বিকেল সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল আচমকাই কেঁপে ওঠে। শিলং প্ল্যাটোর নিচে থাকা বিশাল ওল্ডহ্যাম ফল্ট এক লাফে ১১–১৬ মিটার সরায়, যার ফলে সৃষ্ট হয় ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী ভূমিকম্প। কম্পনের মাত্রা ছিল ৮.২–৮.৩।
বিজ্ঞাপন
সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ ও আশেপাশের অঞ্চলজুড়ে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। শুধুমাত্র সিলেটে মারা যান ৫৪৫ জন। অন্যত্র: সুনামগঞ্জে ২৮৭, উত্তর সিলেটে ১৭৮, সিলেট শহরে ৫৫, দক্ষিণ সিলেটে ৮, করিমগঞ্জে ১০, হবিগঞ্জে ৭ জনের মৃত্যু হয়।
ভূমিকম্পের সঙ্গে সাথে নদীগুলোও উন্মত্ত হয়ে ওঠে। ব্রহ্মপুত্রে তৈরি হয় ২–৩ মিটার উঁচু ঢেউ। নদীর পাড় ধসে যায়, বাজার-ঘাট প্লাবিত হয়, মাটির তরলায়ন হয় এবং অনেক বাড়িঘর হেলে পড়ে কাদায় গলে যায়। এক হৃদয়বিদারক ঘটনায় সুনামগঞ্জে এক নারী নদীর মাঝখানে হঠাৎ তৈরি হওয়া ফাটলে পড়ে যান; স্বামী চেষ্টা করেও তাকে উদ্ধার করতে পারেননি।
বিজ্ঞাপন

রেলওয়ে ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আসাম–বেঙ্গল রেলওয়ের লাইন বিকৃত হয়, বহু ব্রিজ ধসে যায়, টেলিগ্রাফ লাইন ছিঁড়ে পড়ে। চলন্ত ট্রেনের নিচে রেললাইন দেবে যেতে থাকায় একাধিক দুর্ঘটনা অল্পের জন্য এড়ানো যায়।
শিলং শহরে পাথরের দালান, আদালত, চার্চ, স্টেশন ও সরকারি ভবন প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা কম্পনের প্রথম মুহূর্তের শব্দকে “হাজার জাহাজ একসঙ্গে ইঞ্জিন চালু করার মতো” বর্ণনা করেছেন। চেরাপুঞ্জিতে ভূমিধসে প্রায় ৬০০ মানুষ প্রাণ হারান। কম্পনের পর তিনদিনে প্রায় ২০০ আফটারশক অনুভূত হয়। আতঙ্কে মানুষ রাত কাটায় খোলা মাঠে, ঘরে প্রবেশের সাহস পায়নি কেউই।
বিজ্ঞাপন
সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ৫০ লাখ রুপি, যা সে সময়ের হিসেবে বিপুল। হাসপাতাল, কারাগার, আদালত ধসে পড়া, খাদ্য ও ওষুধের সরবরাহে বিলম্ব, যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল থাকা—এই বিপর্যয় কয়েক মাস স্থায়ী ছিল।
গবেষকরা আজও এই ভূমিকম্পকে উদাহরণ হিসেবে দেখান যে, প্লেটের নিচের ফল্টও মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। শিলং প্ল্যাটোর পপ-আপ, নদীর সাইচ, মাটির তরলায়ন—সবই ছিল পৃথিবীর গভীরে জমে থাকা শক্তির ভয়ানক নিদর্শন।
মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১,৫৪২ জন, যার মধ্যে সিলেটেই ৫৪৫ জন। ১৮৯৭ সালের স্মৃতি এখনও সতর্ক করছে, সিলেট ও আশেপাশের অঞ্চল ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ, এবং প্রস্তুতি ও সচেতনতা অপরিহার্য।









