দইয়ের চাহিদা বাড়ায় বগুড়ার মৃৎশিল্পে ফিরেছে নতুন প্রাণ

বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী দই যার স্বাদ ও ঘনত্বের খ্যাতি দেশ-বিদেশজুড়ে সেই দইয়ের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এখন বদলে দিচ্ছে স্থানীয় মৃৎশিল্পের ভাগ্য।
বিজ্ঞাপন
একসময় হাঁড়ি-পাতিলের বাজার হারিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে পড়া এ পেশায়, শেরপুর উপজেলার গাড়ীদহ ইউনিয়নের চন্ডিযান গ্রামের শতবর্ষী মৃৎ কারিগরদের কর্মচঞ্চল হাতে ফিরেছে নতুন প্রাণ, নতুন আয় ও নতুন স্বপ্ন।
দইয়ের বিপুল জনপ্রিয়তার সুফল পড়েছে এ উপজেলার শতবর্ষী মৃৎশিল্পেও। ‘দইয়ের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত এই জনপদের চন্ডিযান গ্রামের মৃৎ কারিগররা জানান, প্রায় ১০০ বছর ধরে তারা মাটির সরা, বাটি ও দইয়ের কাপ তৈরির পেশায় নিয়োজিত। একসময় মাটির হাঁড়ি-পাতিলের চাহিদা কমে যাওয়ায় মৃৎশিল্পকে ‘মৃতপ্রায়’ বলা হলেও এখন দইয়ের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে এই শিল্পে ফিরেছে নতুন প্রাণ ও কর্মব্যস্ততা।
বিজ্ঞাপন
কারিগররা জানান, দইয়ের কাপ ও সরা তৈরিতে প্রথমে মাঝারি আঠালো মাটি সংগ্রহ করা হয়। মাটি কাটার পর তা মেশিনে প্রস্তুত করে, পরবর্তী ধাপে দক্ষ কারিগরদের নিপুণ হাতে আরেক মেশিনে তৈরি হয় কাপ ও সরা। এরপর বিশেষ লাল মাটি গুলিয়ে রঙ করা হয়, যা দইয়ের মান ভালো রাখতে সাহায্য করে। সবশেষে চুলার ভাটায় দুই দিন ধরে পুড়িয়ে প্রস্তুত করা হয় এসব পণ্য। মেশিনের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর সময় ও উৎপাদন খরচ কিছুটা কমলেও বিদ্যুৎ না থাকলে কাজে বিঘ্ন ঘটে বলে জানান তারা।
মৃৎ কারিগরদের ভাষ্য, ঘণ্টায় প্রায় ১,০০০ কাপ তৈরি করা সম্ভব এবং প্রতি ১,০০০ কাপ ও সরায় মজুরি পাওয়া যায় ৭০০ টাকা। বগুড়া ও শেরপুরের দইয়ের খুঁটি, সরা ও কাপের চাহিদা এখন এতটাই বেশি যে সরবরাহ দিতে গিয়ে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। শুধু চন্ডিযান নয়, উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের কল্যাণী, কাশিয়াবালা, নয়মাইল, আরিয়া বাজার ও চান্দাইকোনাসহ পাশের এলাকাগুলোতেও মাটির সরা-কাপ তৈরির কাজ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
বিজ্ঞাপন
এ পেশায় পূর্বে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বেশি যুক্ত থাকলেও এখন মুসলমান সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষও সমানতালে কাজ করছেন। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও উৎপাদন কাজে সহযোগিতা করছেন। কারিগর পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছে, আবার সময় পেলেই পরিবারকে কাজে সহায়তা করে বাড়তি আয়ও করছেন।
মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত রতন পাল বলেন, পাকিস্তান আমলে আমাদের পূর্বপুরুষরা মাটির হাঁড়ি-পাতিল বানাতেন। তখন বাজার কম থাকায় খুব কষ্টে দিন গেছে। এখন দইয়ের চাহিদা বাড়ায় খুঁটি, গ্লাস, কাপ ও সরাসহ মাটির পণ্যের কদর বেড়েছে। আয় দিয়ে সংসার চালাচ্ছি, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখাও করাতে পারছি।
ববিতা রানি পাল বলেন, নারীরাও এখন এ কাজে সহযোগিতা করি। আয় ভালো, পরিবারও ভালোভাবে চলছে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: ধুনটে অতিথি পাখির কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল
স্কুলছাত্র মিথুন পাল জানান, পড়াশোনার পাশাপাশি মাটির কাজ করি। পরিবারকে সাহায্য করি, বাড়তি ইনকামও হয়। দইয়ের চাহিদা বাড়ায় আমাদের ঐতিহ্য আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
কারিগর সাইফুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলামসহ আরও অনেকে জানান, প্রতিদিন ৭০০-৮০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। তবে এ শিল্পে টিকে থাকতে পুঁজি-সংকট বড় সমস্যা। সরকারিভাবে কোনো আর্থিক সহায়তা না পাওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কাজ চালান। অগ্রিম টাকা নিয়ে ঋণ শোধ করতে হয় বলে লাভের পরিমাণ খুবই সীমিত থেকে যায়।
বিজ্ঞাপন
মৃৎপণ্যের ব্যবসায়ী আজিজ জানান, মাটির ১ কেজি পাতিলের ক্রয়মূল্য ১১ টাকা, বিক্রি ১৫ টাকা। কাপ ২ টাকা পিস, কাটা ৫ টাকা পিস রাজশাহীতে যায়। সরার দাম ১৫-২০ টাকা। বগুড়ায় চাহিদা সবচেয়ে বেশি। প্রতি গাড়িতে ২০-৩০ হাজার পণ্য লোড হয়। প্রতি সপ্তাহেই দেশের বিভিন্ন জেলায় রংপুর, দিনাজপুর, ঢাকা, কক্সবাজার ও বরিশালে গাড়ি পাঠানো হয়।
পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল আজিজ বলেন, কারখানা থেকে মাটির দইয়ের সরা, কাপ, খুঁটিসহ অন্যান্য পণ্য পাইকারি কিনে বগুড়া, রংপুর, ঢাকাসহ সারাদেশে সরবরাহ করি। দই ও সরা-কাপের চাহিদা এখন ব্যাপক।
বিজ্ঞাপন
কারিগররা সরকারের কাছে সহজ শর্তে ঋণ, প্রশিক্ষণ, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও আর্থিক সহায়তার দাবি জানিয়ে বলেন, সহায়তা পেলে কারিগররাও লাভবান হবেন, শিল্পও আরও এগিয়ে যাবে।








