কুষ্টিয়ায় ৭ বিয়ে করা সেই রবিজুলের দুই স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার জন্য চাপ


Janobani

জেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৫১ অপরাহ্ন, ৯ই জুন ২০২৪


কুষ্টিয়ায় ৭ বিয়ে করা সেই রবিজুলের দুই স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার জন্য চাপ
ছবি: প্রতিনিধি

"সাত স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার’ কু‌ষ্টিয়ার রবিজুলকে নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে এমন শিরোনাম ভাইরাল হওয়ার পর থে‌কেই তার সংসা‌রে নে‌মে এসে‌ছে সমা‌জ প্রধান‌দের চাপ। মাস চা‌রেক আগে ৬ষ্ঠ স্ত্রী নিজ থে‌কেই তালাক দি‌য়ে চ‌লে গে‌ছেন তার বাবার বা‌ড়ি। এখন ছয় স্ত্রী‌ ও পাঁচ সন্তান‌কে নি‌য়ে তার সংসার। এদি‌কে গ্রা‌মের ২২ প্রধান একসা‌থে হ‌য়ে ইসলামী শরিয়ত মানাতে দুইজন স্ত্রীকে তালাক দি‌তে বাধ্য করা হ‌চ্ছে ব‌লে অ‌ভি‌যোগ তু‌লে‌ছেন র‌বিজুল। এমন‌কি প্রধানরা বিচার ডে‌কে তা‌কে লা‌ঞ্চিত ও দুই স্ত্রী‌কে গ্রাম থে‌কে বের ক‌রে দি‌য়ে‌ছেন ব‌লে জা‌নি‌য়ে‌ছেন। 


শ‌নিবার (৮ জুন) সকাল ১০টায় কু‌ষ্টিয়া সদর উপ‌জেলার পাটিকাবাড়ি ইউনিয়নের পাটিকাবাড়ি বাজা‌রে ২২ গ্রাম প্রধা‌নের উপ‌স্থি‌তি‌তে এ ঘটনা ঘ‌টে। ত‌বে এই অ‌ভি‌যোগ অস্বীকার ক‌রে‌ছেন গ্রাম প্রধানরা। র‌বিজুল ইসলাম(৪০) পাটিকাবাড়ি গ্রামের মিয়াপাড়ার আয়নাল মন্ডলের ছেলে। 


স্থানীয় সূ‌ত্রে জানা গে‌ছে, শ‌নিবার সকা‌ল ১০টায় গ্রা‌মের ২২ প্রধান এক হ‌য়ে পা‌টিকাবা‌ড়ি বাজা‌রে সামা‌জিক বৈঠক ডা‌কেন। সেখা‌নে র‌বিজুল‌কেও ডে‌কে আনেন তারা। বৈঠ‌কে প্রধানের ভূ‌মিকা পালন ক‌রেন স্থানীয় মাতবর ‌না‌জিম মন্ডল। এছাড়াও  ইউনিয়ন আওয়ামী লী‌গের সাধারণ সম্পাদক সফর উদ্দিন,লিটন মন্ডল,মাজিলা দারুস সুন্নাহ বহুমূখী মাদ্রাসার মুহতামিম হাফেজ মঃ মুফতি আলমগীর হোসাইন, পাটিকাবাড়ী বায়তুল আমান জামে মসজিদের পেশ ঈমাম মঃ মীর শফিকুল ইসলাম, পাটিকাবাড়ী হেফজখানা ও বহুমূখী মাদ্রাসার শিক্ষক মিজানুর রহমান, মাজিলা পশ্চিমপাড়া দারুলউলুম হাফিজীয়া ক্বারিয়ানা মাদ্রাসার মুহতামিম ক্বারী মশিউর রহমান প্রমুখ গ্রাম প্রধানরা উপ‌স্থিত ছি‌লেন। 


বৈঠ‌কে  শ‌রিয়ত মোতাবেক চা‌রের অ‌ধিক স্ত্রী রাখার বিধান না থাকার ইসলামী ব্যাখা দেন মুহতামিম হাফেজ মঃ মুফতি আলমগীর হোসাইন।এ সময় র‌বিজু‌লের ৫ম ও ৭ম স্ত্রী উপ‌স্থিত ছি‌লেন। 


র‌বিজুল ইসলাম ব‌লেন, গ্রামের ২২ প্রধান নি‌জেরাই এক হ‌য়ে সামা‌জিক বৈঠক ডে‌কে আমা‌কে উপ‌স্থিত হ‌তে ব‌লে। আমি তা‌দের‌কে ব‌লে‌ছিলাম এইজন্য আমার সময় প্রয়োজন। কারণ আমি যা‌দের বি‌য়ে ক‌রে‌ছি তারা সবাই গরীব ঘ‌রের সন্তান। তা‌দের চলার ম‌তো একটা অবস্থান তৈ‌রি ক‌রে পরবর্তী‌তে এ বিষ‌য়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। কিন্তু তারা আমার কথা না মেনে তা‌দের নি‌জে‌দের ম‌তো ক‌রে আমার দুই স্ত্রী‌কে তালাক দে‌ওয়ার জন্য জোর ক‌রে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর ক‌রে নেয়। আমি তা‌দের তালাক দি‌তে চাই না। সা‌লি‌শের পর তারা আমার দুই স্ত্রী‌কে গ্রাম থে‌কে বের ক‌রে দি‌য়ে‌ছে। আমা‌কে এবং আমার মামা‌কে লা‌ঞ্চিত ক‌রে‌ছে। আমি এ বিষ‌য়ে আইনানুগ ব্যববস্থা গ্রহণ কর‌বো। 


অ‌ভি‌যো‌গের বিষ‌য়ে বৈঠ‌কের প্রধান না‌জিম মন্ডল বলেন, ইসলামী শরিয়ত মোতা‌বেক চার স্ত্রীর বে‌শি রাখার বিধান নেই। সামা‌জিকভা‌বে ব‌সে আমরা  তা‌কে সেটাই বোঝা‌তে চে‌য়ে‌ছিলাম। স্ত্রী‌দের তালাক দি‌তে আপনারা বাধ্য ক‌রতে পা‌রেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তি‌নি ব‌লেন, র‌বিজু‌ল তার দুই স্ত্রী‌কে তালাক দি‌বেন ব‌লে নি‌জেই অঙ্গীকার ক‌রে‌ছেন। আমরা তাকে বাধ্য ক‌রি‌নি, তা‌কে মারধরও ক‌রি‌নি। 


সামা‌জিক বৈঠ‌কে উপ‌স্থিত আরেক গ্রাম প্রধান পা‌টিকাবাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লী‌গের সাধারণ সম্পাদক ও সা‌বেক ইউপি চেয়ারম্যান সফর উদ্দিন ব‌লেন, এটা অ‌বৈধ ‌বি‌য়ে। আমরা তা‌কে বাধ্য ক‌রি‌নি। তার দুই বউ মেনে নি‌য়ে‌ছে। তা‌দের কা‌বি‌ন ও খোর‌পোশ বাবদ দুই লক্ষ টাকাও দেয়া হ‌য়ে‌ছে। 


এ বিষ‌য়ে পা‌টিকাবা‌ড়ি ইউপি চেয়ারম্যান শেখ রেজ‌ভি উজ্জামান ব‌লেন, আমি বি‌ভিন্ন মাধ্যমে সামা‌জিক বৈঠ‌কের বিষয়‌টি জে‌নে‌ছি। যে‌হেতু আমা‌কে প্রধানরা বৈঠ‌কে উপ‌স্থিত থাক‌তে ব‌লে‌নি তাই আমি এ ব্যাপারে তেমন কিছু জা‌নি না। ত‌বে এ ব্যাপা‌রে র‌বিজু‌লের দুই স্ত্রীর সা‌থে কথা বলা সম্ভব হয়‌নি। 


আরও পড়ুন: ৭ বউ নিয়ে সুখের সংসার রবিজুলের


স্থানীয় ও পা‌রিবা‌রিক সূ‌ত্রে জানা গে‌ছে, দরিদ্র পরিবারের সন্তান রবিজুল মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে করেন জেলার মিরপুর উপজেলার বালুচর গ্রামের কিশোরী রুবিনা খাতুনকে। বিয়ের দুবছরের মাথায় এই দম্পতির এক পুত্র সন্তান হয়। পরে বউ ও সন্তান বাড়ি রেখে লিবিয়া পাড়ি জমান রবিজুল। সেখানে টাইলসের কাজ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। পরে লিবিয়াতে পরিচয় হয় কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার হেলেনা খাতুনের সঙ্গে। পরে তারা দুজন সম্পর্কে জড়ান এবং একপর্যায়ে তাদের বিয়ে হয়। তাৎক্ষণিক প্রথম স্ত্রীকে বিষয়টি না জানালেও পরে জানার পর তিনি এ বিয়ে মেনে নেন। এরপর প্রথম স্ত্রী রুবিনাকেও লিবিয়া নিয়ে যান রবিজুল। সেখানে দুই স্ত্রী এবং সন্তান নিয়ে ১২ বছর বাস করেন তিনি। এরপর দেশে ফিরে বাপের ভিটায় দুতলা বাড়ি নির্মাণ করেন। এর কিছু দিন পরেই মোবাইল ফোনে প্রেমের সম্পর্ক হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের নুরুন্নাহারের সঙ্গে। পরে নুরুন্নাহারকে বিয়ে করেন রবিজুল। তবে নুরুন্নাহারের অভিযোগ সম্পর্কের শুরুতে তিনি জানতেন রবিজুলের একজন স্ত্রী আছেন।


রবিজুলের দাবি মায়ের মানত রক্ষায় ধারাবাহিকভাবে তিনি চতুর্থ বিয়ে করেন। তার চতুর্থ স্ত্রীর নাম স্বপ্না খাতুন। বাড়ি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামে। এরপর  তিন মাসে পরপর তিনটি বিয়ে করেন রবিজুল। তার পঞ্চম স্ত্রীর নাম বানু খাতুন, বাড়ি আলমডাঙ্গা উপজেলার ডম্বলপুর গ্রামে। ষষ্ঠ স্ত্রীর নাম রিতা আক্তার। তার বাড়ি জেলার মিরপুর উপজেলার পোড়াদাহ ইউনিয়নে। সর্বশেষ বি‌য়ে করা সপ্তম স্ত্রী মিতা খাতুনের বাড়ি সদর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামে।


দুতলা বাড়ির সাতটি কক্ষে বসবাস করেন স্ত্রীরা। প্রত্যেক স্ত্রীর শয়নকক্ষ আসবাবপত্র দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন একইভাবে।


ত‌বে রবিজুলের দাবি, ‘বিধি সম্মত না হলেও’ তার স্ত্রীদের কারও কোনো অভিযোগ নেই। একসঙ্গে `শান্তিপূর্ণভাবেই’ তারা সংসার করছেন।


আরও পড়ুন: কুষ্টিয়ায় বিএনপির নেতা কর্মীদের সাথে পুলিশের গোলাগুলি


একাধিক বিয়ের ব্যাপারে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কুষ্টিয়ার উপপরিচালক মো. হেলাল উজ জামান বলেন,শরিয়া অনুযায়ী শর্ত সাপেক্ষে কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ চারটি বিয়ে করতে পারেন বৈধভাবে। এজন্য আগের সব স্ত্রীর অনুমতি থাকতে হবে। দাম্পত্য জীবনে সব স্ত্রীর সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এর বাইরে অতিরিক্ত কোনো স্ত্রী গ্রহণের বিধান নেই।"


সামা‌জিক বৈঠ‌কে জোরপূর্বক তালাক দি‌তে বাধ্য করা যায় কিনা প্রস‌ঙ্গে কু‌ষ্টিয়া জজ আদাল‌তের সরকা‌রি কৌঁসু‌লি (পি‌পি) এড. অনুপ কুমার নন্দী  ব‌লেন,সামা‌জিক বৈঠ‌কে চাপ দি‌য়ে কাউকে তালাক দি‌তে বাধ্য করা‌নো আইনের চো‌খে অপরাধ। 


এ বিষ‌য়ে কু‌ষ্টিয়া সদর উপ‌জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) পার্থ প্রতিম শীল জানান, দু্ই প‌ক্ষের সমঝোতার ভি‌ত্তি‌তে সেটা ভিন্ন। কিন্তু জোর জবরদ‌স্তির কোন সু‌যোগ নেই।


জেবি/এসবি