এনসিপির কমিটিতে বিরোধ তুঙ্গে, সাংবাদিকদের হেনস্তা-তালাবদ্ধ করার হুমকি

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদ্য ঘোষিত রাজশাহী জেলা কমিটির আহ্বায়কসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ‘আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ও জুলাই আন্দোলনের বিরোধীতা করার অভিযোগ উঠেছে। সদ্য ঘোষিত এই কমিটি বিলুপ্ত করতে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে দলের একটি পক্ষ।
বিজ্ঞাপন
রবিবার (৩০ নভেম্বর) রাতে রাজশাহী নগরীর গণকপাড়া মোড়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এই আলটিমেটাম দেন। পরে তারা জেলার নতুন আহ্বায়ক সাইফুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজনের কুশপোত্তলিকা দাহ করেন।
এ ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার (০১ ডিসেম্বর) বিকেলে নিজের অবস্থান তুলে ধরে পর্যটন মোটেলে সংবাদ সম্মেলন করছিলেন জেলার আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম। এ সময় এনসিপির দুইজন সমর্থক গিয়ে সাংবাদিকদের হেনস্তা ও তাদেরকে তালাবদ্ধ করার হুমকি দেন। পরে সাংবাদিকরা এর প্রতিবাদ করলে তারা দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
সাংবাদিকদের হেনস্তকারীরা হলেন শোয়েব ও মেহেদী। তারা এনসিপির কোনো পদে না থাকলেও দলটিতে তারা ব্যাপক সক্রিয় বলে জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সোমবার বিকালে রাজশাহী পর্যটন মোটেলে পরিচিতি সভা ও জেলার আহ্ববায়ককে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করছিলেন রাজশাহী জেলার নব-গঠিত আহবায়ক কমিটি। বিকেল ৪টা ৩০মিনিটের দিকে প্রায় ৩০ জন যুবক এনসিপির নেতা ও জুলাই যোদ্ধা পরিচয়ে জেলা কমিটির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলামকে আওয়মী লীগের দোসর বলে তাদের কর্মসূচি ভণ্ডুল করার চেষ্টা চালায়।
এ সময় এনসিপির দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে মহাহানগর এনসিপির দুইজন কর্মী সংবাদ সম্মেলন চলাকালে সভাকক্ষে ঢুকে সংবাদকর্মীদের বের হয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করার আলটিমেটাম দেন। অন্যথায় পর্যটন মোটেলে তালাবদ্ধ করে ভেতরে আগুন দেবারও হুমকি দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন কর্মরত সংবাদকর্মীরা। সাংবাদিকরা একাট্টা হয়ে সেই হুমকিদাতা দুজনকে পর্যটন মোটেলের বাইরে বের করে আনেন।
বিজ্ঞাপন
দীর্ঘ সময় এনসিপির কর্মীদের সঙ্গে সংবাদকর্মীদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলতে থাকে। পরে পুলিশ গিয়ে দুপক্ষকে শান্ত করে। সংবাদকর্মীরা তাৎক্ষণিক এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবি করেন। এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার হওয়া পর্যন্ত এনসিপির সকল কার্যক্রমের সংবাদ কাভারেজ থেকে বিরত থাকবেন বলেও জানান সাংবাদিকরা।
এর আগে শনিবার (২৯ নভেম্বর) রাতে এনসিপি রাজশাহী জেলা ইউনিটের ১০৫ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। সম্প্রতি বিলুপ্ত হওয়া সমন্বয় কমিটির যুগ্ম–সমন্বয়ক সাইফুল ইসলামকে করা হয়েছে নতুন কমিটির আহ্বায়ক।
অভিযোগ উঠেছে, নতুন আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, অস্ত্রধারী যুবলীগ ক্যাডার জহুরুল ইসলাম রুবেল যিনি ২৪’র ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার মিছিলে দুই হাতে গুলি চালিয়েছেন সেই রুবেলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এই সাইফুল। এনসিপির জেলা আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর যুবলীগ ক্যাডার রুবেলের সঙ্গে জেলার নতুন আহ্বায়ক সাইফুল ইসলামকে একটি কর্মসূচিতে পাশাপাশি অবস্থানের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
এরপর এনসিপির জেলা কমিটিতে আওয়াগী লীগ ঘনিষ্ঠ ও জুলাই চেতনাবিরোধী কয়েকজনকে রাখার অভিযোগে এই কমিটি বিলুপ্তে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে রোববার রাতে সংবাদ সম্মেলন করে দলটির একটি অংশ। সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করতে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতা পরিচয় দেওয়া সুমাইয়া আক্তার অভিযোগ করেন, নতুন কমিটিতে আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজনকে রাখা হয়েছে।
তার দাবি, আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং যুবলীগ নেতা জহুরুল ইসলাম রুবেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখতেন—যিনি ৫ আগস্ট রাজশাহীতে ছাত্রজনতার মিছিলে দুই হাতে পিস্তল নিয়ে গুলি করার ঘটনায় বর্তমানে কারাগারে আছেন।
বিজ্ঞাপন
সুমাইয়া বলেন, ‘এই কমিটি জুলাইয়ের শহিদদের প্রতি অপমান। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমিটি বাতিল না হলে আমরা আবার রাস্তায় নামব।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সাবেক নেতা আব্দুল বশীর আল হাদি জানান, সাইফুলের রাজনৈতিক যোগাযোগ নিয়ে তারা দীর্ঘদিন ধরেই এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে সতর্ক করেছেন।
তিনি বলেন, ‘রাজশাহীর শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে তার (সাইফুল ইসলাম) ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাকে জেলা আহ্বায়ক করা হয়েছে—এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
বিজ্ঞাপন
সংবাদ সম্মেলন শেষে তারা ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এনসিপির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরান ইমন এবং জেলা আহ্বায়ক সাইফুল ইসলামের কুশপুত্তলিকা দাহ করে।
এদিকে সোমবার বিকেলে আলাদা সংবাদ সম্মেলনে সাইফুল ইসলাম এসব অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন, বিভ্রান্তিকর ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে দাবি করেন।
তিনি বলেন, অভিযোগগুলো পুরোনো ছবি, ভিডিও ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভুল ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। তিনি ব্যাখ্যা করেন, এক দশক আগের যে ছবিগুলোতে তাকে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে দেখা যায়, সেগুলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের—যেখানে তিনি কবিতা পাঠ বা উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন
বিজ্ঞাপন
তিনি দাবি করেন, তিনি কখনো দলীয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। তিনি বলেন, ‘যদি রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকত, অনেক আগেই সুবিধা পেতাম। রাজশাহী সিটি করপোরেশনে ছোট ব্যবসার অনুমতির জন্য বহুবার আবেদন করেও প্রতিবারই বঞ্চিত হয়েছি।’
তার দাবি, দীর্ঘদিনের সংগঠন–সংশ্লিষ্টতার কারণে এনসিপি তাকে বেছে নিয়েছে, এবং তার অতীত সম্পর্কে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবগত।
বিজ্ঞাপন
এ বিষয়ে জানতে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের সমন্বয়ক সারজিদ আলমকে মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
পরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সম্পর্কে জানতে দলটির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরান ইমনকেও মুঠোফোনে কল করা হয়, তবে তিনিও কোনো সাড়া দেননি।
তবে এনসিপির রাজশাহী মহানগরের আহ্বায়ক মোবাশ্বের আলী বলেন, ‘সাংবাদিকদের সাথে যে ব্যবহারটা হয়েছে সত্যি দুঃখজনক, এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। সাংবাদিকদের সাথে এমন আচরণ কোনভাবেই কাম্য না। সাংবাদিকদের সাথে তো কারো কোনো বিরোধ থাকতে পারে না।’
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও বলেন, ওরা (অভিযুক্তরা) এনসিপির সমর্থক, আমাদের দলের কোনো পদে নেই। ওরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছিল, সেই হিসেবে জুলাই যোদ্ধা এবং সবসময় আমাদের সাথেই এনসিপির জেলা-মহানগরের প্রোগ্রামে থাকে। তারা কেউ ছাত্রশক্তি কমিটি হলে সেখানে আসতে চায়।’








